মিরাজ শামস, আরিফুর রহমান তুহিন
পোশাক রপ্তানিকারকরা ইন্দোনেশিয়ার বাজারে আরও একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চলেছে। কারণ বাংলাদেশ থেকে পোশাক এবং আনুষাঙ্গিক পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ায় পোশাক রপ্তানির জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশকে ২৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে। যেখানে চীন, ভিয়েতনাম এবং সিঙ্গাপুরে মতো দেশগুলো এর থেকে অব্যাহতি পেয়েছে।
সুরক্ষা শুল্ক নীতি অনুসারে, ইন্দোনেশিয়ার পোশাক আমদানিকারকদের ধরনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের প্রতি পিস ১.৩৩ থেকে ৪.৩৪ মার্কিন ডলার পর্যন্ত শুল্ক দিতে হয়।
নতুন এ নীতির কারণে ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশের পোশাক পণ্য রপ্তানি হয়তো বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ ওই নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে পণ্যের দাম বাড়বে।
এই ট্যারিফ হার প্রথম বছরের জন্য প্রযোজ্য হবে। দ্বিতীয় বছরের জন্য রেট হবে ১.২৬ থেকে ৪.১২ মার্কিন ডলার এবং তৃতীয় বরের জন্য রেট হবে ১.২০ থেকে ৩.৯১ মার্কিন ডলার। ১২ নভেম্বর থেকে নতুন শুল্ক হার তিন বছরের জন্য কার্যকর হয়েছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ইন্দোনেশিয়া বেশি জনসংখ্যার কারণে একটি ভালো বাজার হতে পারে। তবে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ শিল্পের উপর বোঝা বাড়াবে।
ইন্দোনেশিয়ায় ২০০০ থেকে ২০২১ অর্থবছরে ৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক সামগ্রী রপ্তানি করা হয়েছিল। যা ২০২০ অর্থবছরে প্রায় ২৯ মিলিয়ন, ২০১৯ অর্থবছরে ৩০ মিলিয়ন, ২০১৮ অর্থবছরে ২০ মিলিয়ন এবং ২০১৭ অর্থবছরে ১৩.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল। গত পাঁচ বছর ধরে দেশটিতে পোশাক পণ্যের রপ্তানি বাড়ছে।
এছাড়া, ইন্দোনেশিয়ায় ২০২১ অর্থবছরে রপ্তানিকৃত টেক্সটাইল পণ্যের মূল্য প্রায় ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২০ অর্থবছরে প্রায় ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল।
বিনিময়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে বাংলাদেশ ২০১৯ সালে ১৮৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের টেক্সটাইল পণ্য আমদানি করে।
বাংলাদেশের যে বস্ত্র আমদানি রপ্তানিমুখী পোশাক উৎপাদনে যায় তা এখানে শুল্কমুক্ত প্রবেশের অনুমতি রয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি সহিদুল্লাহ আজিম বলেন, সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধির হারের সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশের জন্য ইন্দোনেশিয়া একটি প্রতিশ্রুতিশীল বাজার। কিন্তু সাম্প্রতিক শুল্ক আরোপ রপ্তানিকে ব্যাহত করবে।
বাজার দখলে রাখতে অবিলম্বে কূটনৈতিক মাধ্যমে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, যদি আমরা এফটিএ বা পিটিএ স্বাক্ষর করতে সক্ষম হই তাহলে এটি ইন্দোনেশিয়া থেকে ভালো রপ্তানি আয়ের জন্য সহায়ক হতে পারে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান অবশ্য বলেন, শুল্ক চাপানোর আগে মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সঙ্গে আলোচনা করেছিল।
তিনি বলেন, এমনকি আমরা ইন্দোনেশিয়ার সরকারের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তারা এটা সব দেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার সুরক্ষা ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে।
করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং পরবর্তীতে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে ইন্দোনেশিয়া সরকার দেশটির পোশাক শিল্পকে সহায়তা করতেই এ সুরক্ষা কর আরোপ করে।
গত বছর ইন্দোনেশিয়ান টেক্সটাইল অ্যাসোসিয়েশন এবং গার্মেন্ট সেক্টরের জন্য ৫ শতাংশের একটি চক্রবৃদ্ধি বার্ষিক বৃদ্ধির হার (সিএজিআর) প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ সেই পরিকল্পনাটি ধ্বংস করে দেয়।
তবে, বিশ্লেষকরা মনে করেন যে গৃহস্থালি ও মূলধন ব্যয় পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে এই পথ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
সরকার হাইওয়ে এবং বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো উন্নত করে পোশাক প্রস্তুতকারকদের সাহায্য করার জন্যও কাজ করছে। সম্প্রতি চালু হওয়া অমনিবাস আইনের অধীনে অন্তর্ভুক্তকরণ পদ্ধতির শর্তে ব্যবসাকে সহজ করতে সহায়তা করছে।
যদিও ইন্দোনেশিয়া গত দুই দশক ধরে পোশাক তৈরি এবং সোর্সিংয়ের জন্য শীর্ষ ১২টি দেশের মধ্যে একটি। বিশ্বের ব্র্যান্ডগুলো সেখানে দ্রুত বর্ধনশীল দেশীয় বাজারের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
এটি একটি দ্বি-মুখী মুদ্রা। কারণ অনেকেই ভাবছেন যে একটি সুরক্ষা শুল্ক আরোপ করা হলে দেশের ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাকের বাজার ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইন্দোনেশিয়ায় ক্রমবর্ধমান ভোক্তাদের সংখ্যা স্থানীয় এবং বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাক উভয়ের জন্য কেনাকাটার ক্ষেত্রে আরও উচ্চতর বিকল্পের দিকে যেতে পারে।
ইন্দোনেশিয়ার মোট উৎপাদনের আনুমানিক ৩০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটায়। বাকি রপ্তানি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (৩৬ শতাংশ), মধ্যপ্রাচ্যে (২৩ শতাংশ), ইইউ (১৩ শতাংশ) এবং চীনে (৫ শতাংশ)।
এদিকে, সরকার স্থানীয় পোশাক শিল্পের সুরক্ষা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতে, ইন্দোনেশিয়ার সরকার একটি 'নিরাপত্তা তদন্ত' শুরু করার পর নভেম্বর থেকে সুরক্ষা শুল্ক আরোপ করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। কোনো পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি দেশীয় শিল্পের জন্য গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমন আশঙ্কায় ওই শুল্ক নির্ধারণ করতে চেয়েছিল।
বাংলাদেশের শিল্প সংশ্লিষ্টরা তাদের পোশাক শিল্পে এই বাড়তি শুল্কের বিরোধিতা করছেন। ইইউ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডের অর্ডার বাতিলের কারণে তারা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।