রফিকুল ইসলাম
নির্মাণ খাতের অন্যতম প্রধান উপাদান সিমেন্ট। মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে এখন ক্রমশই বাড়ছে এ নির্মাণ সামগ্রীটির চাহিদা।
সরকারি অবকাঠামোগত বিভিন্ন প্রকল্প, দ্রুত নগরায়ণ আর রিয়েল এস্টেটের সম্প্রসারণ- সিমেন্ট শিল্পের বৃদ্ধি করছে। নানা রকম চ্যালেঞ্জের মধ্যেও এ শিল্প এখন ১৫ শতাংশ বাড়ছে প্রতি বছর।
এমনকি মহামারির সময়েও অন্যান্য সেক্টরের মতো এ খাতে করোনার খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। তবে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি কাঁচামালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা বছরের পর বছর ধরে স্থির সাফল্যকে ব্যহত করতে পারে।
টেকসই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ঊর্ধ্বমুখী মাথাপিছু আয় সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে, এ উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছে সিমেন্ট শিল্পও।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৭৬টি সিমেন্ট উৎপাদনকারী কোম্পানি রয়েছে। মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার প্রায় ২০০ কিলোগ্রাম। ২০১৯ সালে ৬১.০২ মিলিয়ন টন সিমেন্ট উৎপাদন হয়।
পেছন ফিরে দেখা
একসময় বাংলাদেশ পুরোপুরি সিমেন্ট আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল, কিন্তু ১৯৯০ সাল থেকে দেশীয় উৎপাদনকারীরা সিমেন্ট উৎপাদন শুরু করেন, যা এখন স্থানীয় চাহিদা পূরণ করছে।
সিমেন্ট উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে- কনফিডেন্স সিমেন্ট লিমিটেড, হুন্দাই সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড, বসুন্ধরা গ্রুপের মেঘনা সিমেন্ট মিলস লিমিটেড, আহাদ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লিমিটেড, আরামিত সিমেন্ট লিমিটেড, সেনা কল্যাণ সংস্থার মোংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লিমিটেড, ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেড, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট লিমিটেড এবং ইস্টার্ন সিমেন্ট লিমিটেড।
১৯২০-এর দশকে বেশ কয়েকটি বড়, মাঝারি ও ছোট কোম্পানি যেমন- শাহ সিমেন্ট লিমিটেড, এমআই সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লিমিটেড (ক্রাউন সিমেন্ট), মেঘনা গ্রুপের ইউনিক সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেড, সেভেন সার্কেল (বাংলাদেশ) লিমিটেড, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড, হোলসিম (বাংলাদেশ) লিমিটেড, রয়্যাল সিমেন্ট লিমিটেড এবং সিমেক্স সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড এ শিল্পের তালিকায় যুক্ত হয়।
প্রধান সিমেন্ট গ্রাইন্ডিং জোনগুলো ধলেশ্বরী নদীর তীরে মুন্সীগঞ্জে, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জে, মেঘনা নদীর তীরের মেঘনাঘাটে, চট্টগ্রাম ও মোংলায় অবস্থিত। এছাড়া ছাতক ও সুনামগঞ্জেও দুটি ক্লিংকারাইজেশন প্ল্যান্ট রয়েছে।
প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ২০ বছর আগেও বাংলাদেশ সিমেন্ট আমদানির ওপর অনেক বেশি নির্ভর করত। এখন দেশীয় কোম্পানিগুলো স্থানীয় চাহিদা পুরোপুরি মেটাচ্ছে। আমরা এখন সিমেন্ট রপ্তানিও করছি।
বাজারে দেশীয় কোম্পানির অবস্থান
ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ১০টি কোম্পানির মার্কেট দখল রয়েছে ৭১.৯৯ শতাংশ। এরমধ্যে শাহ সিমেন্টের দখলে রয়েছে ১২.৯৬ শতাংশ, রাজা বসুন্ধরার ১২.১৩ শতাংশ, তাজার ৮.৭২ শতাংশ, ক্রাউনের ৭.২৭ শতাংশ, সেভেন রিংসের ৭,২১ শতাংশ, প্রিমিয়ারের ৬.১৯ শতাংশ, স্ক্যানরুবির ৫.৩৬ শতাংশ, লাফার্জের ৫.১৬ শতাংশ, আকিজের ৪.১০ শতাংশ এবং হোলসিমের ২.৮৯ শতাংশ।
আর বাকি ২৮.০১ শতাংশ মার্কেট দখলে রয়েছে অন্যান্য কোম্পানির। এ সেক্টরটি প্রায় ৩৫ মিলিয়ন টন সিমেন্ট উৎপাদন করে, যেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা।
চলছে সিমেন্ট রপ্তানি
দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপে এখন সিমেন্ট রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।
প্রতি বছর প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টন সিমেন্ট রপ্তানি হয় ভারতে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৪ লাখ ৮৪ হাজার টাকা মূল্যের সিমেন্ট রপ্তানি করেছে। ২০২০ অর্থ বছরে রপ্তানি হয়েছিল ৮৩ লাখ ডলারের।
বিশ্বের বৃহত্তম বাজার গবেষণা সংস্থা, রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটস’র তথ্যানুসারে, ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী সিমেন্ট খরচের পরিমাণ ৪.৪২ বিলিয়ন টনে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। যেখানে বিশ্বব্যাপী গড়ে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার ৫২১ কিলোগ্রাম।
দ্য বিজনেস পোস্ট-এর সাথে আলাপকালে প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ খাতে জড়িত।
দাম বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে আমিরুল বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সিমেন্টের কাঁচামালের দাম বাড়লে আমরা বাণিজ্যিকভাবে তা সমন্বয় করি। আমি এটিকে দাম বৃদ্ধির পরিবর্তে বাণিজ্যিক সমন্বয় বলি।
তিনি আরও বলেন, আমরা আমাদের কারখানায় প্রতিদিন প্রায় ২৭ হাজার টন সিমেন্ট উৎপাদন করি এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের পাশাপাশি ভ্যাট-ট্যাক্স চ্যালেঞ্জের মতো চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এ খাতে প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করেছি।
খুচরা বাজার পর্যবেক্ষণ
লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ক্রিস্টফ হ্যাসিগের স্বাক্ষরিত গত ১৪ মার্চের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, কোম্পানিটি ২০২০ সালে ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করেছে।
কোম্পানিটির তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে এর কর-পরবর্তী মুনাফা ছিল ২৩৬ কোটি ১৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। যেখানে আগের বছরে এ সংখ্যা ছিল ১৭৩ কোটি ৭৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। এছাড়াও, ২০২০ সালে এর মোট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৪৬০ কোটি ৬০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা এবং ২০১৯ সালে মুনাফা ছিল ৪৫৩ কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
ছাতকে সম্পূর্ণ সমন্বিত সিমেন্ট ও ক্লিংকার প্লান্ট এবং ঢাকা ও খুলনার কাছে তিনটি গ্রাইন্ডিং প্ল্যান্টসহ হোল সিমের বার্ষিক ৪.২ মিলিয়ন টন সিমেন্ট উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে।
২০২০ সালে এর সিমেন্ট বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৩৩.৪ মিলিয়ন টন এবং ২০২১ সালে এটি আরও বাড়তে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
সিমেন্ট শিল্পের প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও এখনও বাংলাদেশ বিশ্বে সিমেন্ট পণ্যের সর্বনিম্ন ব্যবহারকারী দেশের একটি, যেখানে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার প্রায় ২০০ কিলোগ্রাম।
ঢাকার বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রতি ৫০ কেজি ব্যাগে সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৪২০ থেকে ৪৮০ টাকায়।
রাজধানীর ডেমরার আতিক ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন জানান, তারা ৫০ কেজির হোলসিম সিমেন্ট ৪৮০ টাকা, শাহ সিমেন্ট ৪৫০ টাকা, সেভেন রিংস ৪৪০ টাকা এবং থ্রি রিংস ৪৩০ টাকায় বিক্রি করছেন।
বাড্ডায় জিএম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী গোলম মোর্তোজা জানান, তারা ক্রাউন সিমেন্ট ৪৪০ টাকায়, ইনসি ও স্ক্যান সিমেন্ট ৪৬০ টাকায়, ফ্রেশ ও সুপারক্রিট সিমেন্ট ৪৩০ টাকায় এবং এক্সট্রিম ৪২০ টাকায় বিক্রি করছেন।
তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর সিমেন্টের দাম বস্তা প্রতি প্রায় ৫০ টাকা বেড়েছে। সব পণ্যের দাম উৎপাদনকারীদের ওপর নির্ভর করে। তারা খরচ বাড়ালে আমাদেরও চড়া দামে বিক্রি করতে হবে।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন- সিমেন্ট, লোহা, টাইলস ও বৈদ্যুতিক তারসহ মোট ২৬৯টি সংযোগ শিল্প রয়েছে।
এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, বেশিরভাগ পণ্যের দাম বেড়েছে, যা আবাসন খাতে প্রভাব ফেলতে পারে।