আব্দুর রাজ্জাক সোহেল
বাসা-বাড়ি কিংবা অফিসের সৌন্দর্য বর্ধনে যুগযুগ ধরেই ফুলগাছসহ নানা রকম পাতাভরা গাছ টবে শোভা পেয়ে আসছে। তবে এখন দিন বদলেছে, সেই সাথে পরিবর্তন এসেছে মানুষের পছন্দেও।
এখন জীবন্ত এসব গাছ কিংবা ফুলের বিকল্প হিসেবে নগরজীবনের লাখো বাসা-বাড়ি কিংবা অফিসে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কৃত্রিম সাজসজ্জা সামগ্রী, যা অনেকাংশেই সৃষ্টি করছে প্রাকৃতিক আবহ।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করা এসব সাজসজ্জা সামগ্রী সামাজিকভাবেও বেশ গ্রহণযোগ্য। কারণ এগুলো দেখতে অনেকটা প্রাকৃতিক মনে হয়, ময়লা হলে ধুয়ে আবার পরিষ্কারও করা যায়।
কৃত্রিম সজ্জা প্রাচীনকাল থেকেই বেশ গুরুত্ব পেয়ে আসছে। কৃত্রিম ফুল, গাছ, মোমবাতি ধারক, আলংকারিক দেয়াল ঘড়ি, টেবিল ল্যাম্প, কৃত্রিম ফুলের ব্যবস্থাসহ সিরামিক অষ্টভুজাকার পাত্র, ট্রেসহ সিরামিক পাত্র এবং সোনালী রঙের ছাতা, নকশা করা ধাতুর মতো চাহিদা বেড়ে যাওয়া কুটির এবং মাইক্রোতে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করছে।
এসবের উদ্যোক্তা আর প্রধান সুবিধাভোগী হলেন নারীরা। যারা স্ব-কর্মসংস্থান খুঁজে পেয়েছেন, অনেকেই হয়েছেন স্বাবলম্বী।
সামগ্রীগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই বাড়ি, অফিস এবং সাজিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। এর মাধ্যমেই এ শিল্পগুলো বেড়ে উঠছে।
বর্তমানে দেশে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসার কারণে কৃত্রিম অলংকারিক জিনিসপত্রের ব্যবসা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃত্রিম অলংকার ব্যবসার পাশাপাশি ১ থেকে ৯৯ দোকানের ব্যবসা এবং অ্যাকোয়ারিয়াম সংস্কৃতিও একে সমৃদ্ধ করছে।
বিয়ের অনুষ্ঠানে এবং এ ধরনের অন্যান্য অনুষ্ঠানে কৃত্রিম গহনার ক্রমবর্ধমান ব্যবহার কুটির শিল্পকে অলঙ্কার তৈরিতে যুক্ত করেছে।
জীবন যেমন দিন দিন ব্যস্ত হয়ে উঠছে, মানুষ নান্দনিকতার একটি সহজ পদ্ধতি খুঁজছে। সেটি কৃত্রিমভাবে কিংবা যে ভাবেই হোক।
এসব সামগ্রীর চাহিদা দিন দিন বড়ছে। দেশের কুটির শিল্প এসব যোগান দিলেও বেশিরভাগই চীন থেকে আমদানি করা হচ্ছে।
ঢাকার মিটফোর্ড রোডের বিসমিল্লাহ টাওয়ারের এসএইচ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সুজাত হোসেন বলেন, সরবরাহের চেয়ে কৃত্রিম পণ্যের চাহিদা বেশি।
তিনি বলেন, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো আমাদের কাছ থেকে অলংকারিক জিনিস কিনে নিয়ে যায়। একবার আমরা একদিনে ১১ লাখ টাকার জিনিস বিক্রি করেছি। এসব পণ্যের বাজার প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সুজাতের মতো আরও প্রায় ৪০ জন এ ধরনের অভিনব জিনিস আমদানি করেন। নকশাকৃত সাজসজ্জা পণ্য বিক্রির অধিকাংশ আউটলেটের কেবল ঢাকাতেই শোরুম করছে।
যদিও এটির সঠিক কোনো তথ্য নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব পণ্যের আনুমানিক বাজারের আকার প্রায় ১০০ কোটি টাকা এবং ২০ হাজার মানুষ সরাসরি এ খাতে জড়িত। এমনকি মহামারির মধ্যেও কৃত্রিম ফুলের আমদানি অনেক বেশি ছিল।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বার্ষিক আমদানি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০.৬৮ কোটি টাকার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০.৮৩ কোটি টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১.১০ কোটি টাকার সজ্জা সামগ্রী আমদানি করা হয়েছিল।
মানুষ কেন কৃত্রিম জিনিস ব্যবহার করে
প্রাকৃতিক ফুল শুধুমাত্র একবার ব্যবহার করা যায়, যেখানে কৃত্রিম ফুল দীর্ঘ সময় ব্যবহার করা যায় অনায়াসে। নকশা করা আইটেমগুলোর দাম কম এবং নানা আকৃতির হয়ে থাকে, যা নান্দনিক চাহিদা পূরণ করে।
মেরুল বাড্ডার বাসিন্দা জান্নাত আরা মেঘলা ৫ হাজার টাকায় কৃত্রিম ফুলের চারা কিনেছেন।
কেন তিনি কৃত্রিম জিনিস কিনলেন, জানতে চাইলে জান্নাত বলেন, আমার বাড়িতে অনেক প্রাকৃতিক ফুল আছে, কিন্তু সেগুলো শুধু একবারের জন্য। অথচ আমি এ কৃত্রিম ফুল গাছটি দীর্ঘদিন ব্যবহার করতে পারবো এবং দামও কম।
ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের একটি বিউটি শপের মালিক সেলিনা আক্তার বলেন, যখন আমি সাজসজ্জার জন্য প্রাকৃতিক ফুল ব্যবহার করি, তখন বেশ যত্ন নিতে হয়। কিন্তু এই কৃত্রিম গাছটি ঝামেলা মুক্ত।
স্কুলশিক্ষক কামরুন্নাহার কেয়া বলেন, তিনি তার পেশায় এতটাই ব্যস্ত যে প্রাকৃতিক ফুলের দিকে ঝুঁকে নজর দেযার মতো সময় তিনি পান না।
তিনি বলেন, আমার বাড়িতে প্রাকৃতিক ফুল রাখার জায়গা নেই। তাই আমি কৃত্রিম গাছ পছন্দ করি।
মগবাজারের ইতালীয় অপটিক্যাল হাউসের ম্যানেজার রনি বর্মন এর মতে, প্রাকৃতিক ফুল বিশেষ করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের ভেতরে রাখা যায় না, অথচ কৃত্রিম ফুল রাখা যায়।
রনির যুক্তি, আমরা প্রাকৃতিক ফুল বাইরে রাখি। কারণ, তাদের আউটলেট সাজানোর জন্য আলো,বাতাস এবং কৃত্রিম ফুলের প্রয়োজন হয়।
দেশজুড়ে কুটির শিল্পের বিস্তার
কৃত্রিম সামগ্রীর চাহিদা বাড়ায় আশা জাগাচ্ছে দেশের কুটির শিল্পে। এ শিল্পের কর্মীদের বেশিরভাগই নারী, যারা ফুলের অলঙ্কারের মতো কৃত্রিম জিনিসপত্র তৈরি করছেন।
কীভাবে কৃত্রিম জিনিস তৈরি করতে হয় সে বিষয়ে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)।
বিয়ের সামগ্রী বিক্রির দোকানে বাড়ির তৈরি কৃত্রিম অলঙ্কারের চাহিদা বেশি। উদ্যোক্তারা পার্লারে এমন পণ্য সরবরাহ করে, যার দামও কম নয়।
বিসিক প্রশিক্ষক নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, আমরা ইতিমধ্যে ৩৬০ জনকে ফুল তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছি। প্রশিক্ষণের পর অনেকেই উদ্যোক্তা এবং সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
কারুকাজ সখিতা একটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান যা অনুকরণকৃত অলঙ্কার কিভাবে তৈরি করা যায় তার প্রশিক্ষণ প্রদান করে।
প্রতিষ্ঠানের মালিক সামিহা নওরিন বলেন, আমাদের প্রায় ৪০ জন শিক্ষার্থী কৃত্রিম অলঙ্কার উৎপাদন শিল্পে চাকরি পেয়েছে। সারা দেশে এ বিশেষ খাতে প্রায় তিন হাজার মানুষ জড়িত।
ওপ্রে অনলাইন শপের মালিক ইরিন হোসেন ওপ্রে জানিয়েছেন, তিনি মূলত কাপড়ের ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তিনি নারীদের জন্য বিয়ের অলংকার তৈরি কাজ শুরু করেছেন, কারণ এটি অনেক চাহিদা।
তিনি বলেন, যদি এটি ভাল হয়, তবে আমি এ খাতে আরও বিনিয়োগ করব।
রাজশাহীর আয়েশা আক্তার সাথী। যিনি হাতে তৈরি পোশাক তৈরির সাথে জড়িত। এখন ব্যাপক চাহিদার কথা মাথায় রেখে অলঙ্কার তৈরির কাজ শুরু করেছেন।
তিনি বলেন, আমি মাত্র দুই মাস আগে ব্যবসার জন্য গিয়েছিলাম। এখন প্রতি মাসে প্রায় ৪০-৫০টি অর্ডার পাচ্ছি। বেশিরভাগেই সৌন্দর্যের দোকান মালিকদের কাছ থেকে। আমি আশা করি, আগামী দিনে আরও অর্ডার পাবো।
ঢাকায় কারখানা
কৃত্রিম সামগ্রীর কাঁচামালের জন্য মূলত চীনের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ। চাহিদা বাড়ায় বেশ কিছু কারখানা তৈরি হয়েছে। নির্মাতারা তাদের পণ্যে বৈচিত্র্য আনার কথা জানিয়েছেন।
জোরি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় প্রায় ২০০টি দোকান, কৃত্রিম অলঙ্কারের ব্যবসা করে। আর এসব তৈরিতে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এবং মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০০টি ছোট ও মাঝারি কারখানা গড়ে উঠেছে।
কামরাঙ্গীরচরের প্রস্তুতকারক মোহাম্মাদ জহির বলেন, এ ধরনের ব্যবসা এখন গ্রামেও শুরু হয়েছে। কারণ, এর জন্য সামান্য বিনিয়োগ এবং হালকা দক্ষতা দরকার হয়।
তিনি বলেন, আমার কারখানায় ২০ জন লোক অলঙ্কার তৈরিতে নিযুক্ত। আমি প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা উপার্জন করতে পারি।
এপিপি প্রস্তুতকারকের স্বত্বাধিকারী মো. ইসমাইল হোসেন আলমগীর জানান, তার কারখানায় প্রায় ১৫০ জন লোক কাজ করে এবং কেউ কেউ তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য তৈরি করেন।
মিরপুরের মিজান এন্টারপ্রাইজের মালিকের মতে, আমরা প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ টাকা বিক্রি করি এবং আলংকারিক জিনিসের চাহিদা বাড়ছে। এ খাতে কর্মসংস্থানের বিশাল সুযোগ রয়েছে।
সংকটে পড়েছে প্রাকৃতিক ফুলের ব্যবসা
কৃত্রিম ফুলের ক্রমবর্ধমান চাহিদায় প্রাকৃতিক ফুলের ব্যবসা চাপের মুখে পড়েছে। ফুল বিক্রেতাদের দাবি, কৃত্রিম জিনিসের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে তাদের বিক্রি কমে গেছে।
দেশের ফুল শিল্পকে রক্ষা করায় কৃত্রিম ফুলের ব্যবহার কমানোর প্রয়োজন দাবি করে তারা বলছেন, কৃত্রিম ফুল পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
শাহবাগের মালঞ্চ পুষ্প সেন্টারের স্বত্বাধিকারী মো. জুয়েল আহমদ বলেন, মানুষ এখন বারবার ব্যবহারের জন্য কৃত্রিম ফুল ব্যবহার করছে।
তিনি বলেন, প্লাস্টিকের তৈরি ফুল ব্যবহারের কারণে আমাদের বিক্রি কমে গেছে।
বাংলাদেশ ফুল উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আহসান উল্লাহ বলেন, কৃত্রিম ফুলের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে, তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে।
তিনি সরকারের প্রতি কৃত্রিম ফুল আমদানির ওপর আরও কর আরোপ এবং প্রাকৃতিক ফুল চাষে উদ্বুদ্ধ করার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, প্লাস্টিকের ব্যাপক ব্যবহার মাটি ও পানির জন্য ক্ষতিকর।
তিনি আরও বলেন, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য উন্নত বাংলাদেশ গড়তে আমাদের এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একইসঙ্গে প্রাকৃতিক পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন এ পরিবেশবিদ।