প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

বন্ধ ২ কোম্পানিকে জনতা ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিল, ব্যাখ্যা তলব

২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১১:৪৯:৩৮ | আপডেট: ৩ years আগে
বন্ধ ২ কোম্পানিকে জনতা ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিল, ব্যাখ্যা তলব

মেহেদী হাসান

এক সময় ভালো অবস্থানে থাকলেও জনতা ব্যাংকে এখন অনিয়মের যেন শেষ নেই। কারণ, ঋণ বিতরণে ব্যাংকিং বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করেই একের পর এক কেলেঙ্কারি করেই যাচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালিত এ ব্যাংকটি।

এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্কতা আর নিষেধাজ্ঞাও আমলে নিচ্ছে না ব্যাংকটি। এরমাঝেই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি বিতর্কিত লকপুর গ্রুপকে ফের ঋণ সুবিধা দিয়েছে।

আর্থিক অনিয়মের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হওয়া জনতা ব্যাংক চলতি বছর ব্যাংকটির ৬৬৮তম পরিচালনা পর্ষদের সভায় লকপুর গ্রুপের ১১০ কোটি টাকা ঋণের পুনঃতফসিল অনুমোদন করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির এমন অনিয়ম ও জালিয়াতি উদঘাটন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তদন্ত প্রতিবেদনে জনতা ব্যাংকের বেশকিছু ত্রুটি বেরিয়ে এসেছে। ওই প্রতিবেদনের একটি কপি বিজনেস পোস্ট-এর কাছে রয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুন স্টার পলিমার এক্সপোর্ট লিমিটেড এবং লকপুর গ্রুপের ইস্টার্ন পলিমার লিমিটেডের উৎপাদন ও রপ্তানি কার্যক্রম গত বছরের অক্টোবর থেকে বন্ধ রয়েছে। এছাড়া এ দুই অঙ্গ প্রতিষ্ঠান চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যাপক ছাঁটাই করে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রকৃত তথ্য গোপন করে জনতা ব্যাংক ওই প্রতিষ্ঠান দুটিকে ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দেয়, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মের লঙ্ঘন।

গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ তার ৬৪২তম সভায় মুন স্টার পলিমার এক্সপোর্ট লিমিটেড এবং ইস্টার্ন পলিমার লিমিটেডের লেটার অফ ক্রেডিট (এলসি) এর বিপরীতে ৫৮.৪৩ কোটি টাকার দায় ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের অনুমোদন দেয়।

খুলনা-ভিত্তিক ব্যবসায়িক গ্রুপটির ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতি পেয়েছে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক। যে কারণে জনতা ব্যাংকে পুনঃতফসিলের জন্য কোন আপত্তি সনদ (এনওসি) দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে, যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংক দায়গুলো পুনঃতফসিলের জন্য এনওসি দেয়নি, তাই সেগুলো প্রতিকূল শ্রেণিবিন্যাসযোগ্য। কিন্তু, ঋণদাতা জনতা ব্যাংক তাদের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) রিপোর্টে যথাযথ শ্রেণীবিভাগ ছাড়াই দেখিয়েছে। যা ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের আরেকটি লঙ্ঘন।

এ অনিয়মের জন্য দায়ী ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে ম্যানেজমেন্টকে তা অবিলম্বে জানাতে বলেছে জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট এখনও বোর্ডে তা জমা দেয়নি। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে, জনতা ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকই (এমডি) এর জন্য দায়ী।

লকপুর গ্রুপের অনিয়ম
গত বছরের ২৭ জানুয়ারি মুন স্টার পলিমার এক্সপোর্ট লিমিটেডের ৯.৪ কোটি টাকার এলটিআর (ট্রাস্ট রিসিপ্টের বিপরীতে ঋণ) পুনঃতফসিলের জন্য জনতা ব্যাংককে শর্ত সাপেক্ষে অনাপত্তি পত্র (এনওসি) দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক ।

যদিও, বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ডাউন পেমেন্ট হিসেবে মোট ঋণের ৫.৩০ শতাংশ পাওয়ার পর পুনঃতফসিল কার্যকর হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিম দেখতে পায়, কোম্পানি শর্ত অনুযায়ী কোন ডাউন পেমেন্টই করেনি।

এমনকি পরিদর্শনের সময় ঋণের বিরুদ্ধে প্রাথমিক নিরাপত্তা হিসেবে বা দায়বদ্ধতায় অর্থ প্রদানের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দ্য মুন স্টার পলিমার এক্সপোর্ট লিমিটেড এবং ইস্টার্ন পলিমার লিমিটেড বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা নিয়ে পণ্য আমদানি করত। এরপর আমদানি করা ওসব পণ্য দিয়ে রফতানিযোগ্য পণ্য তৈরির পরিবর্তে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে, যা একটি গুরুতর অনিয়ম এবং জালিয়াতি।।

একটি বন্ডেড গুদাম হলো এমন একটি ভবন বা সুরক্ষিত এলাকা, যেখানে কাজযোগ্য পণ্য সংরক্ষণ করা যায় অথবা শুল্ক পরিশোধ ছাড়াই উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।

লকপুর গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে এরইমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

আমজাদ ২০১৩ সাল থেকে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান ছিলেন, যিনি স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে ৭ সেপ্টেম্বরে পদত্যাগ করেন।

আমজাদ হোসেন এর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে বিজনেস পোস্ট। কিন্তু তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

জনতা ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক

এসব বিষয়ে চলতি বছরের ১ আগস্ট জনতা ব্যাংকে একটি চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক । যাতে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে ধারাবাহিক অনিয়মের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মো. আবদুস সালাম আজাদকেও প্রশ্ন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নির্দেশনা লঙ্ঘনের দায়ে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না সেই কারণ দর্শাতেও বলা হয়।

লকপুর গ্রুপের কোম্পানির অনুকূলে কোনো নতুন ঋণ অনুমোদন, সম্প্রসারণ বা বিতরণ থেকে বিরত থাকতে জনতা ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঋণদাতা ব্যাংকটির ব্যাখ্যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সন্তোষজনক নয়। তাই ব্যাংকটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিজনেস পোস্ট-এর প্রতিবেদক এসব বিষয়ে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম আজাদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।

এমনকি, এ প্রতিবেদক ব্যাংকের এমডির সাথে দেখা করতে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে গেলেও তাকে অফিসে পাওয়া যায়নি।

পরে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল জব্বার দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, যখন লকপুর গ্রুপের কোম্পানিগুলো খোলা ছিল, তখন ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছিল।

জব্বার নিশ্চিতভাবে দাবি করেন, আমরা নীতি অনুযায়ী তাদের কাছ থেকে পেমেন্ট নেয়ার পর ঋণের পুনঃতফসিল করেছি।

কেনো ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে।

জনতা ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা

বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ রয়েছে জনতা ব্যাংকের, যার এনপিএল এ বছরের জুন পর্যন্ত ১৩ হাজার ৬৯২.৬৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এটি ব্যাংকের মোট বকেয়া ঋণের ২৩.৫২ শতাংশ।

যদিও, ২০১৭ সালের শেষে এর পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা।

মূলত ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে ক্রিসেন্ট গ্রুপ এবং অ্যাননটেক্স এর ঋণ পরিশোধ না করা-ই মন্দ ঋণের ব্যাপক বৃদ্ধির কারণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকের একক ঋণ গ্রহীতা এক্সপোজার সীমার মানদণ্ড লঙ্ঘন করে ব্যাংক আনোন টেক্স এবং ক্রিসেন্ট গ্রুপকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।

চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৩৪৫ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক।