প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

বাংলাদেশের জন্য বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাজার অস্ট্রেলিয়া

রফিকুল ইসলাম, আরিফুর রহমান তুহিন
২২ মে ২০২৩ ১০:৫৭:২৮ | আপডেট: ২ years আগে
বাংলাদেশের জন্য বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাজার অস্ট্রেলিয়া

চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি গন্তব্য হয়ে উঠেছে অস্ট্রেলিয়া।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে, অস্ট্রেলিয়ার বাজার থেকে ১.০৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা দেশের মোট ৫৪.৬৮ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের ২.৩ শতাংশ।

অভ্যন্তরীণ শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্ট্রেলিয়ায় শুল্কমুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার, পণ্যের বৈচিত্র্য, সে দেশে ব্যাপক বিপণন এবং চীন-অস্ট্রেলিয়া ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বাংলাদেশকে এই মাইলফলক অর্জনে সহায়তা করেছে।

যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে তবে তাদের আয় অদূর ভবিষ্যতে দ্বিগুণ এমনকি তিনগুণ হতে পারে বলে দাবি করেছেন তারা।

এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‌্যাপিড)-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, ‘চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এটি সবার জন্য একটি সুখবর। আমরা বিষয়টিকে স্বাগত জানাই।’

তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদী নীতি ঘোষণার কারণে আমরা অস্ট্রেলিয়ান আমদানিকারকদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। এ কারণে তারা আরও বেশি পোশাকের সোর্সিংয়ের জন্য বাংলাদেশের দিকে মনোনিবেশ করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন উচ্চমানের পণ্য তৈরি করছি এবং মানুষও সেগুলো ব্যবহার করছে। চীন-অস্ট্রেলিয়া ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা দেশটির আমদানিকারকদের তাদের আমদানি গন্তব্যে বৈচিত্র্য আনতে অনুপ্রাণিত করেছে যা আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করেছে। আমি মনে করি এ প্রবণতা দীর্ঘ সময়ের জন্য অব্যাহত থাকবে।’

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘রপ্তানিকারকদের জন্য ৪ শতাংশ নগদ প্রণোদনা এবং বিজিএমইএ ও রপ্তানিকারকদের উদ্যোগের কারণে আমরা অপ্রচলিত বাজারে ভালো পারফর্ম করছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা উচ্চ-প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছি এবং উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরি করছি যা আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। আমাদের কাছে নন-কটন পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর অনেক সম্ভাবনা রয়েছে এবং সেই কারণেই আমরা পণ্য রপ্তানির জন্য ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা চাইছি যা আমাদের আরও উপার্জন করতে সহায়তা করবে।’

অস্ট্রেলিয়ায় কোন পণ্যের চাহিদা রয়েছে?

অস্ট্রেলিয়া বছরে প্রায় ২৭৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করলেও বাংলাদেশের রপ্তানির পরিসর সীমিত। বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ায় তৈরি পোশাক (আরএমজি), হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জুতা, পাট ও পাটজাত পণ্য, ওষুধ, জীবন্ত ও হিমায়িত খাদ্য, চিংড়ি এবং প্লাস্টিক সামগ্রী ইত্যাদি রপ্তানি করে।

ইপিবি তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়কালে, মোট ১.০৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির মধ্যে ৯৬১ মিলিয়ন ডলার এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে এবং ৪৬.৫৯ মিলিয়ন ডলার এসেছে হোম টেক্সটাইল থেকে।

এছাড়া ট্রাঙ্ক ও স্যুটকেস থেকে ৮.৫ মিলিয়ন ডলার, চামড়া ছাড়া জুতা থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার, টুপি থেকে ৩.৩ মিলিয়ন ডলার, চিনির তৈরী মিষ্টান্ন থেকে ২.৪৭ মিলিয়ন ডলার, ঝুড়ির কাজ থেকে ১.৬৪ মিলিয়ন ডলার, রুটি এবং পেস্ট্রি থেকে ১.৬১ মিলিয়ন ডলার, পাটজাত কাপড় থেকে ১.২৫ ডলার, জ্যাম এবং জেলি থেকে ১ মিলিয়ন ডলার, চিংড়ি থেকে ১.০৩ মিলিয়ন ডলার।

এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মহাসচিব মো. মাহতাব উদ্দিন খান দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, আমরা অস্ট্রেলিয়ায় তৈরি পোশাক খাতে ভালো করলেও অন্যান্য পণ্য রপ্তানি থেকে আয়ের বিশাল সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পাটের বৈচিত্র্যময় পণ্য, ফল, শাকসবজি, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় করতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো রোড শো, বাণিজ্য মেলা ও বিজনেস টু বিজনেস সংলাপের পর্যাপ্ত উদ্যোগ রপ্তানি বাড়াতে নেয়া হয়নি। এমনকি তিন বছর আগেও কোনো যৌথ চেম্বার ছিল না। কিন্তু ভারত গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি বাড়াতে চাইছে।’

মাহতাব উদ্দিন খান আরও বলেন ‘অস্ট্রেলিয়ান গ্রাহকরা উচ্চমানের আইটেম ব্যবহার করছেন এবং তারা কখনই নিম্নমানের পণ্যের সাথে আপস করেন না। আমরা যদি পণ্যের গুণমান বজায় রাখতে পারি এবং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে পারি, তাহলে নন-আরএমজি আইটেমগুলির রপ্তানিও বাড়বে।’

তুলিকা ইকোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ইসরাত জাহান চৌধুরী বলেন, ‘বিপণনের অভাবে পাটপণ্য রপ্তানিকারকরা অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও রপ্তানি বাড়াতে পারেননি।’

তিনি বলেন ‘যেহেতু অস্ট্রেলিয়ান ব্যবসার সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ সীমিত, তাই সরকারের উচিত অস্ট্রেলিয়ায় বেশ কয়েকটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা। ভারত ইতোমধ্যেই তা করেছে।’

বিশ্বব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, অস্ট্রেলিয়া ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে ১১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের টেক্সটাইল এবং তৈরী পোশাক আমদানি করেছে, যা ২০১৯ সালে ছিল ৯.৫৮ বিলিয়ন ডলার। এ দুই বছরে, চীন যথাক্রমে ৭.১৯ এবং ৫.৬৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক পণ্য রপ্তানি করেছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ ২০২০ এবং ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় যথাক্রমে ৭১৩ মিলিয়ন ডলার এবং ৭৪৯ মিলিয়ন ডলার মূল্যের টেক্সটাইল এবং তৈরী পোশাক রপ্তানি করেছে। যদিও বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাকের সোর্সিং দেশ এবং ভারত তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।

আন্তর্জাতিক মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়া ২০২১ সালে ৭.৪০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক পণ্য আমদানি করেছে এবং বাংলাদেশ দেশটিতে ৭৬৫.৪৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।

স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, ‘আমরা নতুন বাজারে ভালো অবস্থানে আছি। নতুন বাজারের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া জাপানের পর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। এখন আমরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি অবলম্বন করে উচ্চমূল্যের কাপড় তৈরি করছি। এছাড়া আমাদের উৎপাদন খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। এ কারণে অস্ট্রেলিয়ান ক্রেতারা বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।’

ইপিবির তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে তৈরী পোশাক খাত উচ্চমূল্যের ও বিলাসবহুল পোশাক রপ্তানি করে সর্বোচ্চ আয় করেছে। এই সময়ে, নিটওয়্যার আইটেম রপ্তানি হয়েছে ৬৪৩ মিলিয়ন ডলার এবং ওভেন আইটেম ৩১৮ মিলিয়ন।

নিটওয়্যার এবং বোনা আইটেমগুলোর মধ্যে, ৩৬৮ মিলিয়ন ডলার আয় এসেছে স্যুট এবং ব্লেজার রপ্তানি থেকে, ২৬৯ মিলিয়ন ডলার টি-শার্ট থেকে, ১২৫ মিলিয়ন ডলার জার্সি এবং সোয়েটার থেকে এবং ৪৭ মিলিয়ন ডলার এসেছে শার্ট থেকে। এছাড়াও, বিছানা এবং টেবিল লিনেন ৩৩ মিলিয়ন ডলার এবং টারপলিন ১০ মিলিয়ন আয় করেছে।

সাউথইস্ট সোয়েটারসের প্রধান নির্বাহী পরিচালক মাহবুবুর রহমান লাকি বলেন, ‘আমরা, বিশেষ করে সোয়েটার এবং শীতের কাপড় প্রস্তুতকারীরা, আগস্ট-জানুয়ারি সময়ের মধ্যে অর্ডার সংকটের সম্মুখীন হয়। অস্ট্রেলিয়ান ক্রেতারা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ তারা আমাদের মন্দার সময়েও জিনিস ক্রয় করে।’

র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান রাজ্জাক বলেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক সংকটের কারণে অস্ট্রেলিয়া চীনের নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসবে। এ কারণেই কয়েক বছরের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের বাজারের অংশীদারিত্ব ১০-১২ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশে উন্নীত করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া যদিও নিউজিল্যান্ড একটি ছোট বাজার, তবে তারা উচ্চ মূল্যের আইটেম ব্যবহার করে। আমরা অস্ট্রেলিয়া হয়ে সেখানে পণ্য রপ্তানি করতে পারি।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনেক অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতে বিনিয়োগ করতে পারে কারণ দেশ থেকে তাদের আমদানি বাড়ছে, এবং সরকারের উচিত এই ক্ষেত্রে ফোকাস করা।’