প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

বাড়ছে পাথরের চাহিদা, আমদানি কমাবে দেশীয় খনি

২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৬:০৬:১৯ | আপডেট: ৩ years আগে
বাড়ছে পাথরের চাহিদা, আমদানি কমাবে দেশীয় খনি

রফিকুল ইসলাম

বছরের পর বছর ধরে টেকসই নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে পাথরের ব্যবহার হয়ে আসছে। দেশে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আর মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হওয়ায় এর চাহিদা এখন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। তাই পাথরের আমদানি নির্ভরতা ও খরচ কমাতে দেশীয় খনি থেকেই পাথর সংগ্রহে নজর দেয়া জরুরি বলে মনে করছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।

ভারত, দুবাই, ভিয়েতনাম এবং ভুটান থেকে মূলত দেশে পাথর আমদানি করা হয়। আর এসবের প্রধান গ্রাহক হলো চলমান নির্মাণ প্রকল্প, যেমন- পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রো রেল এবং মহাসড়ক, অর্থনৈতিক অঞ্চল, বন্দর ও প্লান্টস, আধুনিক অফিস এবং আবাসিক কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পগুলো।

আমদানি করা পাথরের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি পাথর ভারত থেকে, ৪০ শতাংশ দুবাই থেকে এবং বাকি অংশ ভিয়েতনাম ও ভুটান থেকে আমদানি করা হয়।

চাহিদা মেটাতে দেশীয় খনি যেমন- সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, শ্রীপুর, লোভাছড়া এবং বিছনাকান্দিতে ১০-১২ টি কোয়ারি রয়েছে। যেখানে দেশীয় চাহিদা মেটাতে ৫০ লাখ টন পাথর উত্তোলন করা যায়, ফলে বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হয়।

পাথরের বাজারের আকার বছরে ৭০০ কোটি টাকার ওপরে এবং এর প্রবৃদ্ধি প্রতি বছর ১৫ শতাংশ বলে ধারণা করা হয়।

মাহমুদা এন্টারপ্রাইজের আমদানিকারক ও স্বত্বাধিকারী জাফর মাহমুদ বলেন, বেসরকারি ও সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প পাথর আমদানির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

তিনি বলেন, এমনকি ৫ বছর আগেও ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার পাথর বিদেশ থেকে আনা হতো। এখন আমদানির পরিমাণ ৭০০ থেকে ৭৫০ কোটি টাকার মধ্যে।

দেশে প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ আমদানিকারক রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫০০ জনের বেশি স্থলবন্দর ব্যবহার করে পাথর আমদানি করেন।

চার ধরনের পাথরের দাম সম্পর্কে ধারণা দেন জাফর। ৩/৪ ইঞ্চি পাথরের দাম প্রতি টন ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা, মানের উপর নির্ভর করে ৫/৮ ইঞ্চি ৩ হাজার ৪০০ টাকা, ১/২ ইঞ্চি ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ১০০ টাকা এবং ১/৪ ইঞ্চি ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ২ হাজার ৯০০ টাকা।

বিজনেস পোস্ট’র সঙ্গে আলাপকালে আকিজ গ্রুপের ম্যানেজার হুমায়ুন কবির জানান, তারা দুবাই থেকে বিভিন্ন আকারের পাথর আমদানি করছেন। কারণ, দেশে ব্যাপকভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে।

তিনি বলেন, দুবাইয়ের পাথর অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো। আমরা আমাদের নিজস্ব প্রয়োজন এবং পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের অধীনে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য পাথর আমদানি করি। এছাড়াও, আমরা সেগুলো বড় গ্রাহকদের কাছেও বিক্রি করি।

গত বছর কোভিড-১৯ এর কারণে পাথর আমদানির পরিমাণ নেমে আসে ৩ লাখ ৫০ হাজার টনে। ২০২১ সালে প্রায় ৯ লাখ টন আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন বলেও জানান হুমায়ুন।

সুনির্দিষ্ট আমদানির পরিসংখ্যান সম্পর্কে জানতে চাইলে আকিজ গ্রুপের ম্যানেজার বলেন, এ খাত সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই, তবে প্রায় ৫৫ শতাংশ পাথর ভারত থেকে, ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ দুবাই থেকে এবং বাকি অংশ ভুটান ও ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা হয়।

বসুন্ধরা, মেঘনা, আবুল খায়ের এবং ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপের মতো বড় কোম্পানিগুলো প্রচুর পরিমাণে পাথর আমদানি করছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ১ কোটি ৮৮ লাখ ২৪ হাজার টন পাথর আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ৭২ লাখ টন নৌপথে এবং ১ কোটি টনেরও বেশি স্থলবন্দর যেমন হিলি, সোনামোসজিদ, মোদ্দোপাড়া, ভোমরা এবং তামাবিলের মাধ্যমের মাধ্যমে আমদানি করা হয়।

পাথরের দাম খুব একটা না বাড়লেও পরিবহন খরচ গত এক বছরে বেড়েছে বলে জানান আমদানিকারকরা। দুবাই থেকে ঢাকায় শিপিং খরচ প্রতি টন ১৩ ডলার থেকে ২৮ ডলারে উঠেছে।

তারা সারাদেশে বাস্তবায়িত বড় প্রকল্পগুলোর স্বার্থে পাথর আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

আমাদের প্রতি টন বিল্ডিং সামগ্রীর জন্য কাস্টমস ডিউটি, পোর্ট ডিউটি, ভ্যাট, এসডি এবং এআইটি হিসেবে ১ হাজার ১৬৭ টাকা দিতে হয়, এভাবেই খরচ বেড়েছে। এ খাতকে শক্তিশালী করতে শুল্ক কমানো উচিত বলে মনে করেন তারা।

শুধু আমদানি নির্ভর না থেকে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও পাথর উত্তোলনের পদক্ষেপের উপর গুরুত্বারোপ করেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এটি করা হলে, খরচ কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে।

ব্যবসায়ীরা বলেন, মহামারির কারণে আমরা কঠিন সময় পার করেছি, কারণ দীর্ঘ সময় স্থলবন্দরগুলো বন্ধ ছিল। এছাড়া, নির্মাণ কাজও থমকে যায় করোনার কারণে।

সূত্র জানায়, প্রতিদিন প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ পাথর বোঝাই ট্রাক ৬০ টন পাথর নিয়ে প্রতিটি স্থলবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করে। সব বন্দর মিলিয়ে মোট ১ হাজার থেকে ১৫০০ ট্রাক ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে।

পাথর ও বালু ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম নিয়ম মেনে দেশের খনি থেকে পাথর উত্তোলনের অনুমতি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

মেসার্স আলিফ বিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী বলেন, নদী ও স্থলপথে চাঁদাবাজি ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যাদের সিলেট থেকে ঢাকা পর্যন্ত কমপক্ষে ১৫ পয়েন্ট এ চাঁদা দিতে হয়।

তিনি জানান, ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত এবং পুলিশসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ অর্থ আদায় করে। এছাড়া, ইজারাদাররা ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা দাবি করে।

এই ব্যবসায়ী বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষিতে সরবরাহ সংকটের কারণে পাথরের দাম বাড়ানো দরকার, অন্যথায় তাদের বড় ক্ষতি হতে হবে।

কাঁচপুর ব্রিজ এলাকা থেকে ডেমরা বাজার পর্যন্ত ১০০ জন নিবন্ধিত ব্যবসায়ী রয়েছেন এবং প্রায় ১০-১২ লাখ মানুষ সরাসরি পাথর শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, এখন ভবনগুলোকে শক্তিশালী করতে প্রায় ৮০ শতাংশ ছাদ ও পাইলিংয়ের কাজে পাথর ব্যবহার করা হয়।

একসময় পাথরের জায়গায় ইটের চিপ ব্যবহার করা হতো, এখন পরিস্থিতি পরিবর্তীত হয়েছে উল্লেখ করে অসাধু ব্যবসায়ীদের রুখতে সরকারকে পাথরের মূল্য নির্ধারণের আহ্বান জানান তিনি।

বিল্ডিং ফর ফিউচার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তানভিরুল হক প্রবাল বলেন, ভবনের নকশা বিশ্লেষণ না করে, কাঠামো নির্মাণের জন্য পাথরের পরিমাণ গণনা করা কঠিন।

যদিও, থাম্ব রুলস অনুযায়ী আমরা বলতে পারি যে, বাণিজ্যিক ভবনের এক বর্গফুট নির্মাণের জন্য প্রায় ১ থেকে ২ সিএফটি পাথর প্রয়োজন।।

তিনি বলেন, সাধারণ হিসাব অনুযায়ী একটি বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের জন্য ৫ ট্রাক বালির বিপরীতে ১০ ট্রাক পাথরের প্রয়োজন হয়।