রাশেদ আহমেদ
গত চার বছর ধরে রাজধানীর ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, শেওড়াপাড়া, কাজিপাড়া, মিরপুর-১০ এবং মিরপুর-১২ এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর প্রভাব ফেলছে চলমান মেট্রোরেল প্রকল্প।
করোনা মহামারির পাশাপাশি এসব উন্নয়নমূলক কাজের কারণে ব্যবসায়ীরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তাদের বিষয়ে নির্বিকার প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা।
শেওড়াপাড়ার ব্যবসায়ী মাহমুদুর রহমান বলেন, “মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা আমাদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়নি। এমনকি তারা আমাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা পর্যন্ত করেনি।”
শেওড়াপাড়া, কাজিপাড়া এবং মিরপুর-১০ এলাকার তিনটি মেট্রোরেল স্টেশনে ৫০০ টিরও বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেননা চলমান কাজ আশেপাশের দোকানগুলির সম্মুখভাগ ব্লক করে রাখছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা শুরু থেকেই ক্ষতিপূরণ দাবি করে আসছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত করেনি। আর তাতে অনেক ব্যবসা ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। ঋণ খেলারপির বোঝা মাথায় নিয়ে ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে রীতিমতো বাধ্য হয়েছে।
মেট্রোরেল প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক (পরিবেশ স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন) কৃষ্ণ কান্তি বিশ্বাস বলেন, এখন পর্যন্ত মেট্রোরেল স্টেশন এলাকায় উচ্ছেদ করা ১ হাজার ৪০০ জন বিক্রেতাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্থায়ী ব্যবসায়ীদের কেউ ক্ষতিপূরণ পায়নি।
তিনি বলেন, “আমরা দোকান মালিকদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেইনি। কারণ তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া আমাদের আওতাভুক্ত নয়। কাজেই তাদের সাহায্য করার সুযোগ নেই।”
সরকার মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) মেট্রোরেল প্রকল্প হিসেবে পরিচিত ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬ বাস্তবায়ন করছে।
২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১০ কিলোমিটার প্রথম এলিভেটেড মেট্রোরেল ২০২৪ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ হওয়ার আশা করা হচ্ছে।
ইলেকট্রনিক জিনিসপত্রের দোকান হোসেন ব্রাদার্সের মালিক নুরুল আমিন জানান, মেট্রোরেল নির্মাণ কাজ ২০১২ সালে শুরু হলেও ২০১৬ সাল থেকে মেট্রোরেল প্রকল্পের ফলে তাদের উপর যে প্রভাব তা বুঝতে শুরু করেন।
হতাশ নুরুল আমিন বলেন, “আমার মাসিক বিক্রি কমে গেছে। আগের চেয়ে এক-চতুর্থাংশেরও কম বেচাকেনা হচ্ছে এখন। ঋণের বোঝায় আমি রাতারাতি আমার ব্যবসা বন্ধও করতে পারছি না।”
সাম্প্রতিক সময় দেখা গেছে, রোকেয়া সরণির ফুটপাথে বড় বড় স্ল্যাব এবং খুঁটি পড়ে আছে। এগুলো জনসাধারণের চলাচলও বাধাগ্রস্ত করছে।
সিমেন্ট বাজার, রপ্তানি পোশাক, ফার্নিচার এবং জুতার দোকানসহ বেশ কয়েকটি দোকান ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় এরই মধ্যে ৬০০ টিরও বেশি দোকান বন্ধ হয়ে গেছে কিংবা অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়েছে।
ভাগ্যকুল মিষ্টান্ন ভান্ডারের দোকানী নিরঞ্জন বাবু জানান, এখন তিনি প্রতিদিন ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা বিক্রি করতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু এর আগে প্রতিদিন প্রায় ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা করে বিক্রি করতেন তিনি।
মেট্রোরেল তার পুরো রুটে ব্যবসা-বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে এর বেশিরভাগই মেট্রোরেলের স্টেশন এলাকায়।
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, মেট্রোরেল স্টেশনের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পরই তাদের বিক্রি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। কারণ স্টেশনের উভয়পাশে জনসাধারণের চলাচল কমে গেছে।
কারওয়ান বাজার মেট্রোরেল স্টেশনের কাছে এক হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী বলেন, “আমার দৈনিক লেনদেন ছিল প্রায় এক লাখ টাকা। কিন্তু এখন আমার যতটুকু বিক্রি হয়, তা আমার দোকানের মাসিক ভাড়া আদায় করার জন্যও যথেষ্ট নয়।”
এসময় ভাড়াটিয়া খুঁজতে দোকানের সামনে বেশ কয়েকটি “টু লেট” সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেছে।
মিরপুরের তাবাসসুম বেডিংয়ের মালিক আমদাদুল হক মিলন বর্ণনা করেন, চলমান সংকটের মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য কীভাবে তিনি তার ব্যবসা মুদিখানায় পরিণত করেছেন।
তিনি বলেন, “আমি অনেক ঋণের নিয়ে ফেলেছি। আমি এখনও আশা করছি যে প্রকল্পের পর আবার সুদিন ফিরে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ চাইলে আমাদের বিষয়গুলো আমলে নিতে পারে।”
মেট্রোরেল উত্তরা থেকে মতিঝিলে ৩৫ মিনিটের মধ্যে যাত্রী পরিবহন করবে।
উত্তরা উত্তর, উত্তরা, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর- ১১, মিরপুর- ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় ও মতিঝিলে ১৬টি স্টেশনে মেট্রোরেল যাত্রী তুলবে এবং নামাবে।
জুলাই মাসের মাসিক অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুসারে, ফাস্ট-ট্র্যাক প্রকল্পের সামগ্রিক অগ্রগতি ছিল ৬৮.৪৯ শতাংশ। প্রথম ধাপে ৮৮.১8 শতাংশ এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দ্বিতীয় ধাপে ৬৬.৭৪ শতাংশ অগ্রগতি রয়েছে।
এছাড়া ট্র্যাক ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি স্থাপন এবং গাড়ি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ৬০.৬৬ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথম ধাপের মেট্রোরেলের উদ্বোধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে উদ্বোধন করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক জানান, দেশজুড়ে করোনা মহামারির কারণে প্রকল্পের কাজ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্রকল্পের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।