রফিকুল ইসলাম
দেশে দ্রুত নগরায়ণ আর অর্থনৈতিক সক্ষমতা ভালো হওয়ায় পরিবর্তন আসছে মানুষের জীবনযাত্রায়। এরই প্রেক্ষিতে ক্রমশই বাজার বাড়ছে স্যানিটারি ওয়্যার এবং বাথরুমের জিনিসপত্রের।
এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গড়ে ১৫ শতাংশ বার্ষিক বৃদ্ধি হচ্ছে এসব পণ্যের বাজারের। এতে সামগ্রিক বাজারের আকার বছরে এখন প্রায় ৬০০-৭০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
দেশীয় উৎপাদকরা এ ক্রমবর্ধমান আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্রের বাজারের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম হবে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে প্লাস্টিক, ব্রাশ ও সিরামিক দিয়ে বিভিন্ন ধরনের স্যানিটারি এক্সেসরিজ যেমন- বিব কক ওয়াটার ট্যাপ, শাওয়ার, ওয়াটার ক্লোসেট কমোড এবং স্কোয়াট টয়লেট, ওয়াশ বেসিন, বেন্ড তোয়ালে রড এবং স্কোয়াট টয়লেট তৈরি করে ৫০-৬০টি মূল কোম্পানি রয়েছে। তোয়ালে রিং, সাবান কেস, টিস্যু ধারক, কাচের বেসিনের তাক এবং বুদবুদ জালির নেট।
এসব পণ্যের বাজারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান হলো- আকিজ, আরএফএল, আবুল খায়ের গ্রুপের স্টেলা, সাত্তার, শরীফ, আরএকে, নাজমা, সজিব, ফ্যান্টাসি এবং হাবিব মেটাল ইত্যাদি।
দ্য বিজনেস পোস্ট-এর সাথে আলাপকালে হাবিব মেটালের স্বত্বাধিকারী হাবিবুর রহমান বলেন, আমরা পাঁচ থেকে সাত ধরনের বাথরুমের ফিটিং তৈরি করি, যার মধ্যে পানির কল, ঝর্ণা, টিস্যু হোল্ডার এবং পিতলের সাবানের কেস রয়েছে। তিনি আরও বলেন, একসময় আমাদের ব্যবসা খুব ভালো ছিল, কিন্তু এখন আমরা জায়ান্ট কোম্পানি এবং বিদেশি পণ্য আমদানির কারণে চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছি।
এছাড়া করোনা মহামারির সময় কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি আমাদের জন্য অন্যান্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এক কেজি পিতলের দাম এক বছরে ১৬০ টাকা বেড়ে ৩৩০ টাকা থেকে ৪৯০ টাকা হয়েছে, যা দেশীয় পণ্যের উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে জানান হাবিবুর।
তিনি আরও বলেন, নতুন নতুন উদ্ভাবনী পণ্য উৎপাদনে আমাদের দক্ষ জনবল না থাকায় প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা খুবই কঠিন।
রাজধানীর সিদ্দিক বাজারের রাসেল স্যানিটারির স্বত্বাধিকারী মো: কামরুল হাসান বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভবন নির্মাণসহ উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে স্যানিটারি জিনিসপত্রের চাহিদা দ্রুত বেড়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের ব্যবসা মহামারি করোনা এবং প্রতিযোগিতার কারণে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এক সময় বিভিন্ন জেলা থেকে বিপুল গ্রাহক স্যানিটারি জিনিসপত্র কিনতে সিদ্দিক বাজারে আসত, কিন্তু এখন কোম্পানির মালিকরা জেলায় ডিলার নিয়োগ করায় আমাদের জন্য নতুন চ্যালঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে।
এছাড়া অতিরিক্ত ভ্যাট আরোপ তাদের ওপর আরেকটি ধাক্কা দিয়েছে বলেও জানান ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, আগে আমরা প্রতি বছর ১৪ হাজার টাকা বার্ষিক প্যাকেজ ভ্যাট দিতাম, কিন্তু এখন আমাদের প্রতি মাসে ৩ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হচ্ছে।
কামরুল বলেন, আমি একটি পানির কল ২৫০-৮০০ টাকা, সাবানের কেস ২০-১০০ টাকা, তোয়ালে ২০০-৮০০ টাকা, টিস্যু হোল্ডার ১০০-২৫০ টাকা, এসএস বাবল গ্রেটিং নেট ২৫-৬০ টাকায় বিক্রি করছি। দেশে এখন বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড এবং ৫০টির বেশি নন-ব্র্যান্ড কোম্পানি রয়েছে।
প্রথমে ১৯৭৬ সালে দেশে টাইলস এবং স্যানিটারি পণ্য উৎপাদনের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) এর বাংলাদেশ ইনসুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারি ওয়্যার ফ্যাক্টরি লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়।
আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে উৎপাদন ৬০.৩২ শতাংশ বেড়েছে।
বিসিআইসি ম্যানেজার মো: আখতারুজ্জামান বলেন, স্যানিটারি ওয়্যার পণ্যের উৎপাদন ২১ অর্থবছরে ৯৯৪ টন বেড়েছে, যা অর্থবছর ২০-এ ছিল ৬২০ টন। আমরা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সব পণ্য উৎপাদন করি এবং সেগুলো শক্তিশালী এবং টেকসই।
বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ) তথ্য বলছে, প্রায় ১৮টি সিরামিক স্যানিটারি ওয়্যার কোম্পানি বাংলাদেশে কাজ করছে। এসব কোম্পানি দেশীয় চাহিদার ৬৫.৯২ শতাংশ পূরণ করছে এবং বাকি ৩৪.০৮ শতাংশ পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০ অর্থবছরে ১ হাজার ৫৮৪.৭০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ছিল, যখন এ খাতে উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১৪৭.৫ লাখ পিস। এ খাতে প্রায় ৭ হাজার ৮০২ জন প্রত্যক্ষভাবে জাড়িত।
বিসিএমইএ-এর তথ্য আরও বলছে, বাংলাদেশ ২০২০ অর্থবছরে ৪৪৪.৯৭ কোটি টাকার সিরামিক স্যানিটারি ওয়্যারের সমাপ্ত পণ্য আমদানি করেছে, যেখানে একই সময়ে রপ্তানি করেছে ৫.৩৯ কোটি টাকার পণ্য।
হাতিরপুল এলাকার মিতালি স্যানিটারির ব্যবস্থাপক মীর শাহাদাত হোসেন জানান, তারা টোটো, ক্লাসিক্যাল, গ্রোহে, কট্টো, জাকুয়ার, আর্টিজসহ বিভিন্ন বিদেশি ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রি করেন।
তিনি আরও বলেন, গ্রাহকদের একটি অংশ বিদেশি পণ্য চায়। আমরা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বাথরুমের জিনিস বিক্রি করি। মূলত, আমরা চীন থেকে পণ্য আমদানি করি। যদিও চীনা পণ্য ভারত, কোরিয়া, থাইল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কায় উৎপাদিত হয়।
শাহাদাত আরও বলেন, চীন থেকে সমুদ্রপথে পণ্য বাংলাদেশে আনতে তাদের তিন থেকে চার সপ্তাহ সময় লাগে।
তিনি বলেন, গত কয়েক মাস ধরে আমাদের বহন খরচ দ্বিগুণ হয়ে ২ লাখ টাকা থেকে ৪ লাখ টাকা হয়েছে। এছাড়া বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিদর্শনের সময় আমাদের বন্দরে অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। এটি আমাদের ব্যবসায় প্রভাব পড়ে।
তিনি আরও জানান, তিনি একটি কমোড ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন, যা তিন মাস আগে ১৮ হাজার থেকে ১৯ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল। সাধারণ বেসিনের একটি পিস ৪ থেকে ৭ হাজার টাকা এবং একটি বক্স বেসিন ১৮ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।
বাংলাদেশ পাইপ অ্যান্ড টিউবওয়েল মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক পারভেজ আলম চুন্নু বলেন, আমাদের সংগঠন স্যানিটারি, পাইপ ও নলকূপ ব্যবসায় দেশের প্রধান সংস্থা। সিদ্দিক বাজার ও হাজী ওসমান গণি রোডে প্রায় ১ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়াও, দেশে প্রায় ৮০০-৯০০ ছোট কারখানা রয়েছে যেখানে স্যানিটারি জিনিসপত্রের বিভিন্ন অংশ তৈরি করা হয়।
তিনি আরও বলেন, উৎপাদন থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মী এখন দেশে স্যানিটারি আনুষাঙ্গিক বিভাগে নিযুক্ত। আইটেম প্লাস্টিক, সিরামিক এবং তামা দ্বারা উৎপাদিত হয়। দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশই দেশীয় কোম্পানিগুলো পূরণ করে।
১০ থেকে ১৫ শতাংশ বার্ষিক বৃদ্ধির সাথে স্যানিটারি জিনিসপত্রের বাজারের আকার প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা হবে বলেও জানান পারভেজ।
অন্যদিকে, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের শাইন স্যানিটারি ওয়্যার এবং ফিটিংস, জোপেক্স, ম্যাটাডোর, ঝর্ণা স্যানিটারি এবং লিরা প্লাস্টিক তৈরি স্যানিটারি সামগ্রী তৈরি করছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মুখপাত্র কামরুজ্জামান কামাল বলেন, আমরা মেটাল দিয়ে আরএফএল বাথরুমের ফিটিং এবং প্লাস্টিকের উপাদান দ্বারা শাইন স্যানিটারি ওয়্যার এবং ফিটিং নামে এবিসি বাথরুমের ফিটিং তৈরি করছি।
তিনি বলেন, আমরা ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান এবং নেপালসহ ২০টি দেশে আমাদের শাইন স্যানিটারি ওয়্যার এবং ফিটিং পণ্য রপ্তানি করি। আমরা আমাদের ধাতব জিনিসপত্রও রপ্তানির পরিকল্পনা করছি। তবে আমরা গ্রাহকদের ভবিষ্যৎ চাহিদা অনুযায়ী আরও উদ্ভাবনী পণ্য উৎপাদনের চেষ্টা করছি।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক আরও উল্লেখ করেন, তারা রংপুরে একটি কারখানা স্থাপনের পর ২০১৩ সালে বাজারে পানির কল সরবরাহ শুরু করেছিলেন। বার্ষিক প্রায় ৮০০ টন পণ্য এখন কারখানায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধির সাথে উৎপাদিত হয়। আরএফএল বাথরুমের জিনিসপত্র বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ৪ হাজার ৫০ টাকায়।
এছাড়াও, ২০১১ সালে হবিগঞ্জে কারখানা স্থাপনের পর শাইন পণ্য বাজারে আসে। প্রতি বছর কারখানায় ২৩ শতাংশ বৃদ্ধির হারে প্রায় ৫ হাজার ৪০০ টন পণ্য তৈরি হয়। এসব পণ্য ৩৭ টাকা থেকে ২১ হাজার ৫০৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হয় বলেও জানান কামরুজ্জামান।