মোহাম্মদ নাহিয়ান
দেশের বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন স্থান ও জলাশয়ে শখ করে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার, বিনোদনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে দেশীয় অর্থনীতিতে। উন্মুক্ত স্থানে বিনোদনের এ খাতে বিনিয়োগ একদিকে যেমন মানুষের শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করছে, তেমনি লাভবানও হচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
পর্যটন খাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভ্রমণকারীদের এ সুযোগ দেওয়ায় দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়েছে বিনোদনের জন্য বড়শি দিয়ে মাছ শিকারে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা।
বেশ কয়েকজন বিনোদনপ্রেমী বড়শি দিয়ে মাছ শিকারকারীর সঙ্গে দ্য বিজনেস পোস্ট’এর কথা হয়। তারা জানান, নিছক বিনোদনের জন্য মাছ শিকার নিজেদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, বিষন্নতা কিংবা এবং দুশ্চিন্তা দূর করে। কারণ এতে ডিজিটাল মাধ্যমের চরম আসক্তি ছেড়ে কিছু সময়ের জন্য হলেও প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া যায়।
এ কাজে জড়িত শাইখ আদনান নিতন বলেন, শৈশব থেকেই আমি খাল আর পুকুরে মাছ ধরছি। আমি আট বছরেরও বেশি সময় ধরে এতে জড়িত। আমার অনেক বন্ধুও বিনোদনের জন্য মাছ শিকারে খুব আগ্রহী।
তিনি বলেন, বিনোদনের জন্য মাছ ধরার জায়গা অনেক কম। সব জেলায় মাছ ধরার মতো জলাশয় নেই। সরকারের উচিত এ বিনোদনমূলক বিষয়টিতে নজর দেওয়া, যা আমাদের অর্থনীতিতেও অবদান রাখতে পারে।
একই কথা বললেন শখের মাছশিকারী সাইফ মোহাম্মদ আনোয়ার নিটনও। তিনি বলেন, আমি প্রায় ৩০ বছর ধরে এতে যুক্ত। ছোটবেলায় বাবার সাথে মাছ ধরা শুরু করলেও, এখন এটি আমার আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। এতে আমি আনন্দ পাই।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বিনোদনমূলক পদ্ধতিটি এখন দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে খুব ব্যয়বহুল, এরপরও অনেকেই এটি করছে। বর্তমানে, কিছু খাল এবং পুকুরের মালিক দিন প্রতি মাছ ধরার জন্য অনেক টাকা নির্ধারণ করছেন।
গাজীপুর ও পূবাইলে কিছু খাল ও পুকুর রয়েছে। যেখানে একজন অ্যাংলারকে প্রতিদিন মাছ ধরার জন্য প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়।
রাজধানীতেও অ্যাংলারদের জন্য বিভিন্ন জায়গা রয়েছে। এরমধ্যে গুলশান লেক, ধানমন্ডি লেক, ঢাকা জাতীয় চিড়িয়াখানা লেক, ব্যাংক কলোনী লেক (সাভার) অন্যতম।
ঢাকার বাইরে নাটোরের জলকোল দীঘি, কুমিল্লার ধর্মসাগর দীঘি, বাগেরঘাটের পোচা দীঘি এবং ঘোড়া দীঘি এবং দিনাজপুরের রামসাগর দীঘিসহ কিছু জনপ্রিয় মাছ ধরার জায়গা রয়েছে।
দ্য বিজনেস পোস্টে'র সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশের জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক মো. আব্দুল লতিফ জানান, চিড়িয়াখানার ভেতরে তাদের দুটি বড় দীঘি রয়েছে।
তিনি বলেন, যে কেউ প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবার দিনব্যাপী মাছ ধরতে পারেন ওই দীঘিতে। এজন্য প্রত্যেকের পরিশোধ করতে হবে ২ হাজার টাকা আর মাছ শিকার করতে পারবেন ৩টি ছিপ দিয়ে। উভয় দীঘিতেই বিভিন্ন ধরনের মাছ রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মাছ শিকারের এ পদ্ধতি এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের টিকিট বিক্রি আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বলে জানান জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক।
অ্যাংলিং ইন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা নাসিম হাসান জানান, প্রথম সংগঠন হিসেবে দেশীয় অ্যাংলারদের নিয়ে একটি কমিউনিটি গড়ে তুলেছেন তিনি। তার মতে, প্রায় ৭০ হাজার মানুষ সরাসরি বিনোদনকেন্দ্রিক এ মাছ শিকারে জড়িত।
তিনি বলেন, বিশেষ এ বিনোদনমূলক কাজ বাংলাদেশে এখন জনপ্রিয় হচ্ছে। আমরা একদিনের মাছ ধরার ট্রিপ, একাধিক দিনের মাছ ধরার ট্রিপ এবং তারও বেশি ফিশিং ট্রিপসহ বিভিন্ন মাছ ধরার ট্রিপের প্রস্তাব দিয়ে থাকি।
নাসিম হাসান বলেন, আমাদের দেশে বসবাসকারী অনেক বিদেশী নাগরিকের মাছ ধরার খুব আগ্রহ আছে। অনেকেই আমাদের অফার গ্রহণ করেন। আমরা অ্যাংলারদের জন্য স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় ভ্রমণের ব্যবস্থা করে থাকি।
নাসিম জানান, ২০১৮ সালে তারা রাশিয়ান সরকারের কাছ থেকে একটি আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন এবং তাদের সংস্থা অ্যাংলিং সেক্টরে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিল।
বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক মো. জিয়াউল হক হাওলাদারের মতে, অ্যাংলিং একসময় অভিজাত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন বিভিন্ন আয়ের লোকেরা এ ধরনের বিনোদনের জন্য আগ্রহী। এখন অনেক অ্যাংলিং সোসাইটিও রয়েছে।
তিনি বলেন, যদি এ ধরনের বিনোদন শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়, তাহলে এটি আরও বিকশিত হবে। সরবরাহ করত হবে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম।
মাছ ধরার সরঞ্জাম যেমন রড, রিল, হুক, লুরস, ববার্স, সিঙ্কার, সুইভেল, লাইন কাটার মূলত চীন, কানাডা, থাইল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই আমদানি করা হয়।
বাংলাদেশকে অ্যাংলিংয়ের জন্য আন্তর্জাতিক গন্তব্য হিসেবে গড়ে তুলতে দেশের জলাশয় সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন জিয়াউল হক হাওলাদার। এ লক্ষ্যে একটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ গঠনের পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, এটি করা হলে দেশের অর্থনীতি এবং পর্যটন খাতে ইতিবাচক প্রভাব ভূমিকা রাখবে।
নড়াইলের অরুণিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরফান আহমেদ বলেন, এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত, যা ক্রমেই মানুষের মাঝে জনপ্রিয় হচ্ছে। অ্যাংলিং হতে পারে এতে জড়িতদের জন্য আয়ের একটি বড় উৎস।
আমরা আমাদের রিসোর্টে ৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিনোদনমূলক মাছ ধরার বিষয়টি প্রচার করছি। আমরা স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় অ্যাংলিং ইভেন্টের ব্যবস্থা করি। এ রিসোর্টটি অ্যাংলিংয়ের জন্য দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় স্থান হতে পারে বলেও দাবি করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি বিজনেস ওয়্যার এর রিপোর্ট অনুসারে, ২০২০ সালে বিনোদনমূলক মাছ ধরার সরঞ্জামগুলোর বৈশ্বিক বাজার ছিল ১২.৬ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৭ সাল নাগাদ ১৬ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক অলাভজনক সংগঠন অ্যালব্রাইটন ট্রাস্ট, মোয়াট অ্যান্ড গার্ডেনস জানিয়েছে, বড়শি দিয়ে মাছ শিকার দীর্ঘ মেয়াদী অসুস্থ ব্যক্তিদের মানসিক রোগ, আচরণগত সমস্যা এবং মানসিক চাপ থেকে সেরে উঠতে সাহায্যের পাশাপাশি থেরাপির সুবিধাও দেয়।
ব্রিটিশ জার্নাল অব স্পোর্টস মেডিসিনের একটি গবেষণা বলছে, মনোনিবেশ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে অ্যাংলিং।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, প্রকৃতিতে হাঁটা কিংবা কেবল গাছের নিচে সময় কাটানো মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। যা মনোযোগের মাত্রা বাড়াতে সহায়ক।