করোনা ও রোজার কারণে ২০১৯ সালের পর থেকে বৈশাখসহ জাতীয় উৎসবগুলোতে বেচা-কেনা একেবারেই কমে গেছে দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোর। এই সময় ঈদের ব্যবসা দিয়েই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন তারা। গত বছর পর্যন্ত করোনার প্রভাব থাকায় ঈদের ব্যবসাও খুব একটা ভাল করতে পারেনি হাউজগুলো। তবে এবার পুরোপুরি সংকট কাটিয়ে গত তিন বছরের তুলনায় বিক্রি ভাল হবে বলে আশা করছেন তারা।
ফ্যাশন উদ্যোক্তাদের আশা সারা বছর যা বিক্রি হয়েছে ঈদকে কেন্দ্র করে তার চেয়ে বেশি বিক্রি হবে এবার। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মন্দা খুব একটা বাধা হবেনা বলেই মনে করছেন তারা।
ফ্যাশন উদ্যোক্তারা বলছেন, গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা অনুসারে অন্য উৎসবগুলোতে মানুষ নতুন শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, ফতুয়া ইত্যাদি পোশাক না কিনলেও ঈদুল ফিতরের সবাই কিছু না কিছু কেনেন। কারণ এই ঈদটা আসলে ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে সামাজিক উৎসব হিসেবে পরিণত হয়েছে। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এই উৎসবে অংশ নিতে চায়, সবাই চায় পরিবারের মানুষগুলোকে খুশি রাখতে। এক্ষেত্রে নতুন জামা কাপড়ই প্রথম পছন্দ থাকে। এছাড়া গত বছরের মতো এবারও ১লা বৈশাখ পালিত হবে রোজায়, তাই মানুষ পয়লা বৈশাখের আনন্দটা ঈদে পুষিয়ে নিতে চাইবে।
এসব দিক বিবেচনায় নিত্যপণ্যের চাপে থাকা অর্থনৈতিক মন্দা সত্বেও দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর বিক্রি ভালো হবে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা। করোনার প্রভাব না থাকায়ও ঈদের ব্যসার জন্য একটি ইতিবাচক দিক বলছেন তারা।
বিভিন্ন দেশী ফ্যাশন হাউজ ঘুরে দেখা গেছে, সাদা-কালো, অঞ্জন’স, আড়ং, দেশী-দশ, রং বাংলাদেশসহ দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলোর প্রস্তুতি গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেকটাই ভাল।
এবারের ঈদ কালেকশন ইতোমধ্যেই শোরুমগুলোতে চলে এসেছে। গত বছরের তুলনায় এবার ঈদ কালেকশনের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি ডিজাইন ও মানের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র দেখা গেছে। অনেকে বিক্রির অপেক্ষা করলেও কয়েকটি ফ্যাশন হাউসের বিক্রি ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
এদিকে এবার ঈদ গরমের মধ্যে হওয়ায় পোশাক ডিজাইনেও এসব বিষয় মাথায় রেখেছে ফ্যাশন হাউসগুলো। শার্ট, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, সালোয়ার, কামিজের মতো পোশাকগুলোর অধিকাংশই সুতি কাপড়ের মধ্যে ডিজাইন করা হয়েছে। দাম যাতে মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যে থাকে সে দিকেও খেয়াল রাখা হয়েছে।
সাদা-কালোর সত্ত্বাধিকারী ও ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফইএবি) এর সাবেক সভাপতি সৈয়দ আজহারুল হক আজাদ বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, যারা পাইকারি বিক্রি করেন তাদের বিক্রি অনেক আগে থেকে শুরু হলেও আমারা যারা শোরুমগুলোতে খুচরা বিক্রি করি তাদের বিক্রি শুরু হতে আরও এক সপ্তাহ লাগবে। তবে আমাদের ঈদ কালেকশন ইতোমধ্যে বাজারে চলে এসেছে, যার মধ্যে কিছু কিছু বিক্রিও হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ‘গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার বিক্রি ভাল হবে এই প্রত্যাশা রেখেই আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি এ বছর। কারণ গত বছর আমাদের আশানুরূপ বিক্রি হলেও করোনার কারণে আমাদের প্রত্যাশাটাই কম ছিল। এবার যেহেতু করোনা নেই, বৈশাখের বিক্রিও হবে না, আর ঈদুল আজহায় কোরবানিতেই খরচ বেশি তাই সব মিলিয়ে ঈদুল ফিতরটাই পোশাক কেনার জন্য বাকি থাকে।’
এফইএবি তথ্য মতে, দেশে ছোট বড় মিলিয়ে দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো প্যান্ট, শার্ট, পাজামা, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, সালোয়ার কামিজসহ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি পোশাক বেচা-কেনা করেন। তার মধ্যে অর্ধেকই হয় শুধু ঈদুল ফিতরের সময়।
কয়েক বছর আগেও দুই ঈদ ছাড়াও পয়লা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৬ই ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চসহ ছয়টি উৎসবেই দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর ব্যপক প্রস্তুতি থাকতো। কারন এসব উৎসবের সঙ্গে সংঙ্গতি রেখে পোশাকের চাহিদাও ছিল অনেক। কিন্তু করোনার পর থেকে এই হিসাব একেবারেই বদলে গেছে। এসময় ঈদ ছাড়া অন্য উৎসবগুলোতে বিক্রি খুব একটা হচ্ছে না। এখন অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কায় ঈদুল আজহার বিক্রির আশাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। কারন এই ঈদে মানুষ কোরবানিকেই প্রধান্য দিয়ে থাকেন।
এফইএবি সভাপতি ও ফ্যাশন হাউস অঞ্জন’স- এর সত্ত্বাধিকারী শাহিন আহম্মেদ বলেন, ঈদুল ফিতর সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব হিসেবে আলাদা গুরুত্ব বহন করে। এই উৎসব সবাই সামিল হয়, সবাই কেনাকাটা করে। আর কেনাকাটার প্রথম পছন্দই থাকে ফ্যাশন আইটেম। তাই করোনার পর এই প্রথম আমরা একেবারেই স্বাভাবিক অবস্থার ব্যবসা প্রত্যাশা করছি। আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছি। আমাদের পোশকের কালেকশনের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি ও পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ডিজাইনেও বৈচিত্র এনেছি। তবে বাজার পুরোপুরি বুঝা যাবে আর এক সপ্তাহ পর ঈদের বিক্রি মোটামুটি শুরু হলে।’
তিনি বলেন, শুধু যদি বড় ব্র্যান্ড হাউজগুলোর হিসাব ধরা হয় তবে হয়তো খুব বেশি হবে না। কিন্তু দেশীয় ফ্যাশন হাউজ বললে এর ব্যপ্তি অনেক বড়। এর ব্যবসা ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে। করোনার আগে আমাদের সারা বছরই বিভিন্ন উৎসব ঘিরে বড় অঙ্কের বিক্রি হতো, তাই ঈদুল ফিতরে বিক্রির অংশ সারা বছরের বিক্রির ৫০ শতাংশের অনেক নিচেই ছিল। কিন্তু করোনার পর অন্য উৎসবগুলোর বিক্রি কমে আসায় ঈদুল ফিতরে সারা বছরের ৫০ শতাংশের বেশি হচ্ছে।’
আড়ং- এর চিফ অপারেটিং অফিসার মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, ইতোমধ্যে ক্রেতারা হাউজগুলোতে আসছে এবং কিনছেন। আমাদের গত এক সপ্তাহের ঈদের বিক্রির চিত্র বলছে এবার দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর বিক্রি ভালই হবে। আমাদের প্রস্তুতি ও আশা খুবই ভাল যাবে।
দাম বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, যেহেতু সুতা, রং সহ অন্যান্য কাঁচা মালের দাম বেড়েছে, ফলে তার প্রভাব পোশাক তৈরিতে কিছুটা পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমরা খরচ সমন্বয় করে পোশাক তৈরি করেছি, যাতে কারো বাজেট ফেল না করে। ধরা যাক যে ব্যক্তি গত বছর ১৫০০-২০০০ টাকায় একটা পাঞ্জাবি কিনেছেন এবারও সেই দামেই কিনতে পারবেন, তবে ডিজাইনে কিছুটা পার্থক্য থাকবে। পোশাকে এমব্রয়ডারিসহ বিভিন্ন কাজ কিছুটা কমানো হয়েছে, যাতে বাড়তি খরচটা সমন্বয় হয়। যাদের বাজেট বেশি তাদের জন্যও পোশাক বানানো হয়েছে।’