আব্দুর রাজ্জাক সোহেল
নগরায়ণের ফলে সারা দেশেই কমছে খেলার মাঠ, ক্রমশই বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের সুযোগ হারাচ্ছে শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী মানুষ। অবশ্য, এর মাঝেই খেলাধুলার সামগ্রী ব্যবসা বছরে বাড়ছে প্রায় ২৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, খেলার মাঠে প্রবেশাধিকার রয়েছে মাত্র ২ শতাংশ শিশু।
ঢাকা ও বেশিরভাগ শহুরে এলাকায় খেলার মাঠের অভাব শিশুদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, যারা এখন ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ছে ডিজিটাল ডিভাইসের দিকে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণ হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে ঢাকায় বিগত বছরগুলোতে খেলার মাঠ ও পার্ক বিলুপ্ত হয়েছে, শিশুদের খেলাধুলার জায়গা নেই, যা একটি সুস্থ জাতি গঠনের পূর্বশর্ত।
তবুও, হাজার হাজার শিশু আর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তাদের খেলাধুলার পাশাপাশি বিনোদনের জন্য খেলার মাঠ বা খোলা জায়গার বিকল্প হিসেবে এখন রাস্তা, পার্কিং এলাকা ও বাড়ির ভেতরের জায়গাকে বেছে নিয়েছে। ফলে, ক্রীড়া পণ্যের বাজার গত বেশ কয়েক বছর ধরে একটি ঊর্ধ্বমুখী দেখা যাচ্ছে।
অলিম্পিক গেমস, কমনওয়েলথ গেমস, আইসিসি বিশ্বকাপ এবং ফিফা বিশ্বকাপের মতো বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া ইভেন্টের ক্রমবর্ধমান মিডিয়া কভারেজও এ ধরনের ব্যবসা বাড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। কারণ, তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন ক্রীড়া পণ্য এবং আনুষাঙ্গিক সামগ্রী ক্রয় করতে উৎসাহিত হচ্ছে খেলা দেখে।
এছাড়াও, তরুণদের মধ্যে কোনো একটি খেলোকে তাদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেয়ার প্রবণতা এবং ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বাড়ায় বাংলাদেশের ক্রীড়া সামগ্রীর বাজার উৎসাহিত করার মূল কারণ বলে মনে হচ্ছে।
আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ক্রীড়া কার্যক্রমকে প্রসারিত করছে এবং তাদের নিজ নিজ শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের খেলাধুলার জিনিসপত্র ক্রয়ে বাজেটও বাড়াচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলেও খেলাধুলার পণ্যের অনেক চাহিদা রয়েছে। গ্রামীণ শিশুদের খেলার মাঠ পর্যাপ্ত থাকায় সেখানে এসব সামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে। যদিও, শহরের বাসিন্দারা খেলার মাঠের অনুপস্থিতির কারণে তারা ইনডোর গেমের দিকে ঝুঁকছে। যা খেলাধুলার সামগ্রীর চাহিদা ধরে রাখতে সহায়তা করছে।
শরীয়তপুর কলেজের ছাত্র মো: সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের গ্রামে অনেক খেলার মাঠ দখল করা হলেও এখানে এখনও সব ধরনের খেলাধুলাই চলছে।
তিনি বলেন, এলাকা ভিত্তিক স্পোর্টস ক্লাবগুলো এখন প্রতিটি এলাকায় রয়েছে। আমরা একটি গ্রামীণ ক্রীড়া ক্লাবও প্রতিষ্ঠা করেছি। যেটি, ফুটবল এবং ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন করে। এজন্য জার্সি, ফুটবল, টেনিস বল এবং ক্রিকেট ব্যাটসহ অনেক ক্রীড়া সামগ্রীর প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশ স্পোর্টস গুডস মার্চেন্টস ম্যানুফ্যাকচারস অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসজিএমএমআইএ) তথ্য অনুযায়ী, ক্রীড়া সামগ্রীর বর্তমান বাজারের আকার প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা, যার বার্ষিক বৃদ্ধির হার ২০-২৫ শতাংশ।
বিএসজিএমএমআইএ’র তথ্যও বলছে, বছরে প্রায় ১০০ আমদানিকারকের দ্বারা ক্রীড়া পণ্যের ২ হাজার কন্টেইনার দেশে আমদানি করা হচ্ছে।
শহরের তুলনায় এখন গ্রামে খেলাধুলার পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কারণ, এখনও পর্যাপ্ত খেলার মাঠ বা খোলার জায়গাসহ খেলাধুলার প্রচুর সুযোগ রয়েছে গ্রামে।
শামীম বলেন, যদিও এ ধরনের ব্যবসায় মহামারির কারণে ২ হাজার কোটি টাকার আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে, তবে এটি শেষ পর্যন্ত ফিটনেস পণ্যগুলোর সাথে ইনডোর গেমস পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির পথ উন্মোচন করেছে।
সরকার দেশের ক্রীড়া ব্যবসাকে অনুপ্রাণিত করতে থাকলে মাদকের ব্যবহার ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে বলেও পরামর্শ দেন তিনি।
দেশীয় উৎপাদক এবং খুচরা বিক্রেতা ছাড়াও, বিদেশী খুচরা বিক্রেতারাও ব্যবসার সুযোগ খুঁজতে বাংলাদেশে তাদের খেলাধুলার দোকান খোলায় আগ্রহী।
এদিকে, ফরাসি ক্রীড়া সামগ্রীর খুচরা বিক্রেতা ডেকাথলন বাংলাদেশের ফিটনেস সরঞ্জাম ব্যবসার ক্রমবর্ধমান বাজারকে লক্ষ্য করে ২০১৯ সালে ঢাকার উত্তরায় প্রথম আউটলেট খোলে।
নতুন ওই দোকানে ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবল, সাঁতার, সাইক্লিং, ট্রেকিং, হাইকিং এবং হাঁটার পাশাপাশি স্পোর্টস টেক্সটাইল, ব্যাকপ্যাক, তাঁবু এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক এবং ফিটনেস পণ্য রয়েছে।
কোম্পানিটি ঢাকা স্টোরের জন্য প্রধানত ভারতের গুদাম থেকে পণ্য সংগ্রহ করবে। পাশাপাশি বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান আর রিটার্নও গ্রহণ করবে।
ডেকাথলনের প্রায় সকল প্রধান উন্নত দেশসহ ৫৪টি দেশে ১ হাজার ৫০০টি দোকান রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতে ৭০টি দোকান এবং শ্রীলঙ্কায় একটি বড় দোকান রয়েছে। কোম্পানিটির বার্ষিক আয় ১২ বিলিয়ন ইউরো।
দেশীয় ক্রীড়া সামগ্রীর চাহিদা ব্যাপক
সম্ভাবনাময় এ খাতে ক্রমেই বাড়ছে দেশীয় উৎপাদকদের অবদান, যারা বর্তমানে প্রায় ৪০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করছে। আর বাকি অংশ পূরণ হয় চীন, পাকিস্তান এবং ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যে।
মাত্র ১ দশক আগেও বাংলাদেশ স্থানীয় ভোগ মেটানোর জন্য বিশ্ববাজারের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল।
বিএসজিএমএমআইএ’র তথ্য অনুযায়ী দেশীয় বাজারে প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ স্পোর্টস আইটেম ব্যবহার করা হয়, যেখানে উৎপাদকরা স্থানীয়ভাবে ব্যাট, বল, গ্লাভস, স্পোর্টস ব্যাগ, হেলমেট, ক্যারাম, অ্যাঙ্কলেট, হাঁটুর ক্যাপ, মোজা এবং জালসহ মাত্র ২০০ আইটেম উৎপাদন করতে পারে।
বিএসজিএমএমআইএ’র সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, বর্তমানে, বক্সিং-সংক্রান্ত সমস্ত পণ্য দেশেই তৈরি হয়, যার জন্য আমাদের আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল এবং এখন আমরা আমাদের দেশীয় বাজারের জন্য ফুটবল তৈরির পরিকল্পনা করছি।
দ্রুত নগরায়ণে বাড়ছে ঘরোয়া ক্রীড়া সামগ্রীর চাহিদা
নগরায়ণের ফলে খেলার মাঠ ও খোলা জায়গা দ্রুতই কমছে। এতে বেশিরভাগ শহুরে মানুষও ইনডোর গেমে অভ্যস্ত হওয়ায় বাড়ছে অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া সামগ্রীর চাহিদা।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের তথ্য বলছে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের অধীনে প্রায় আড়াই কোটি বাসিন্দার জন্য অন্তত ২ হাজার পার্ক ও ৪ হাজার খোলা মাঠ প্রয়োজন।
কিন্তু খেলার মাঠ আছে মাত্র ২৩৫টি। যেখানে ১৪১টি প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ এবং মাত্র ৪২টি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।
মূলত খেলার মাঠের অভাবে নগরবাসী ধীরে ধীরে ক্যারাম, টেবিল টেনিস, লুডু, ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল ও লং টেনিসের মতো ইনডোর গেমের দিকে ঝুঁকছে।
গুলিস্তান থেকে ক্যারাম বোর্ড কিনেছেন এমন একজন ব্যাংকার ওয়াজেদ হোসেন বলেন, আমি এখন টেবিল টেনিস, লুডু এবং ক্যারামসহ ইনডোর গেমে সময় দিচ্ছি। কারণ, অন্যান্য খেলাধুলার সুযোগ আমাদের জন্য খুবই সীমিত।
শহরের লালবাগ এলাকায় বসবাসকারী ওয়াজেদ বলেন, ছোটবেলায় আমি ফুটবল, ক্রিকেট ও হাডুডু খেলতাম কিন্তু খেলার মাঠগুলো ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, এতে খোলা জায়গার অভাবে নগরবাসীর জন্য তা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে, ব্যস্ত শহরের জীবনে সতেজ ও সুস্থ থাকার জন্য আমি বাড়িতে আমার বাচ্চাদের সাথে টেবিল টেনিস, ক্যারাম এবং লুডু খেলতে পছন্দ করি।
গুলিস্তানের স্পোর্টস মাস্টারের ব্যবস্থাপক আবদুল কবির বলেন, ইনডোর স্পোর্টস পণ্যের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং নগরবাসীর কাছেও জনপ্রিয় হচ্ছে।
এখন, সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো ক্যারাম বোর্ড, যখন ধনীদের মধ্যে জনপ্রিয় টেবিল টেনিস আর বাস্কেটবল।
ফুটবল সামগ্রীর চাহিদা সবচেয়ে বেশি
সারা দেশে ফুটবল এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র যেমন বুট, মোজা এবং পায়ের পাতার চাহিদা রয়েছে সারা দেশে।
বাংলাদেশ স্পোর্টস গুডস মার্চেন্টস ম্যানুফ্যাকচারস অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, দেশে বছরে ৫০ লাখ ফুটবল এবং ২ লাখ ক্রিকেট ব্যাট ব্যবহার হয়।
বিএসজিএমএমআইএ-এর সভাপতি এম আর শামীম বলেন, ফুটবল-সংক্রান্ত আনুষাঙ্গিক অন্যান্য পণ্যের তুলনায় বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত আইটেম।
তিনি বলেন, যদিও বাংলাদেশে খেলাধুলার বিষয়ে ক্রিকেট অনেক আলোচিত, তবুও আমরা জার্সি, মোজা, পাদুকা এবং অ্যাঙ্কলেটের মতো ফুটবল সম্পর্কিত জিনিসপত্র বিপুল পরিমাণে বিক্রি করতে পারি।
এ প্রসঙ্গে গুলিস্তানের শান স্পোর্টের সেলস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টের প্রধান মাহেদী হাসান বলেন, ফুটবল শিখতে ও খেলতে অন্য যেকোনো খেলার চেয়ে কম সময় লাগে।
যেহেতু মানুষ তাদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তারা খেলাধুলার জন্য খুব কমই সময় পায়, আর ফুটবল খেলাধুলার মধ্যে সর্বোত্তম মাধ্যম। সে কারণেই ফুটবল সংক্রান্ত সামগ্রীগুলোর সব সময় চাহিদা ভালো থাকে।
ব্যবসার চ্যালেঞ্জ ও চাহিদা
দ্রুতই খেলার মাঠ হারিয়ে যাওয়া আর দেশীয় উৎপাদকদের জন্য নীতিগত সহায়তার অভাব সম্ভাবনাময় এ সেক্টরের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
বর্তমানে আমদানিকৃত ক্রীড়া সামগ্রীর তুলনায় দেশীয় উৎপাদনকারীরা ভালো করছেন। তারপরও নীতিগত সমর্থনের অভাবে তারা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যবসায়িক কর্মক্ষমতা অর্জন করতে পারছে না।
বিএসজিএমএমআইএর সচিব মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, সরকার দেশীয় উৎপাদকদের উৎসাহিত করলেই এ খাত আরও বাড়তে পারে।
আশপাশের দেশগুলো থেকে কিছু বিদেশি পণ্য দেশীয় বাজারে পাচার হওয়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী।
বিএসজিএমএমআইএ সভাপতি এম আর শামীম বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী শুল্ক ফাঁকি দিয়ে যখন অবৈধভাবে পণ্য আনছে, যদিও আমদানির জন্য আমাদের অধিক পরিমাণে শুল্ক দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, অবৈধভাবে যেসব পণ্য দেশে আসছে সেগুলো কম দামে বিক্রি হয়। আর এ কারণে আমরা সেসব পণ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একই দামে তা বিক্রি করতে পারি না।