ঈদের বাকি এখনও দুই সপ্তাহ। এর মধ্যেই শার্ট, প্যান্ট ও গেঞ্জিসহ তৈরি পোশাকের পাইাকারি বড় বাজার সদরঘাট ও কেরানীগঞ্জের মার্কেটগুলোতে বেচাবিক্রি জমে ওঠেছে। নিয়মিতই নতুন নতুন ঈদ কালেকশন আসছে মার্কেটগুলোতে।
সেই সঙ্গে ভিড়ও বাড়ছে বুড়িগঙ্গার দুই তীর ঘেষে গড়ে ওঠা ছোট-বড় ৩০০ বেশি মার্কেটে। এই ব্যস্তাতা আগামী ২০ রোজা পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পোশাক তৈরির খরচ বেশি হওয়ায় মুনাফা কম হলেও বেচাবিক্রি বাড়তে থাকায় খুশি স্থানীয় কারখানা মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, পাইকারি বাজারগুলোতে ইতোমধ্যে ৭০ শতাংশ বিক্রি শেষ। বাকিটা হবে আগামী এক সপ্তাহে। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানের জন্য শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, গেঞ্জি, থ্রি পিস, বাচ্চাদের পোশাকসহ তৈরি পোশাক নিতে আসছেন। গত দুই বছর ব্যবসায়ীক মন্দা কাটিয়ে ওঠেছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। করোনা পূর্ব ঈদের মতোই বেচাবিক্রি ফিরে এসেছে।
তবে এবার তৈরি পোশাকের কাপড়ের বাড়তি দাম কিছুটা চ্যালেঞ্জে ফেলেছে কারখানা মালিকদের। তারা বলছেন, শার্ট, প্যান্টসহ বিভিন্ন রেডিমেইড পোশাকের কাপড় কিনতে হয়েছে প্রতি গড়ে ২৫-১০০ টাকা বাড়তি দিয়ে। এছাড়া অন্যান্য খরচও বেড়েছে। ফলে প্রতিটি জামায় বাড়তি খরচ হয়েছে ১৫০ টাকার মতো। কিন্তু করোনা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ ক্রেতারা পোশাকের বাড়তি দাম দিতে চায় না। ফলে তূলনামূলক কম মুনাফায় পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে।
শনিবার সদরঘাটের হকার্স মার্কেট, লেডিস পার্ক মার্কেট, কেরানিগঞ্জের জিলা পরিষদ মার্কেট, শহিদুল আলম মার্কেট, মসজিদ মার্কেট, আলম টাওয়ার, আহসান উল্লাহ টাওয়ারসহ বিভিন্ন হোসিয়ারি ও রেডিমেট জামাকাপড়ের মার্কেটগুলো ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলছে বেচাবিক্রি। সকালের দিকে অনেক ব্যবসায়ী কথা বলার ফুরসতও পাচ্ছেন না। প্রতিটি দোকানেই ব্যবসায়ীরা ঈদকে কেন্দ্র শার্ট, প্যন্ট, পাঞ্জাবি, গেঞ্জি, ফতুয়া, মেয়েদের থ্রি পিস, ফ্রক, সালোয়ার, কামিজ, বাচ্চাদের জামাসহ বাহারি তৈরি পোশাকের পসরা সাজিয়ে রেখেছেন। প্রতিটি দোকানেই রয়েছে ৪-৫টি করে আলাদা ডিজাইনের জামা কাপড়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ক্রেতারা (খুচরা বিক্রেতা) আসছেন তাদের চাহিদা মতো পোশাক কিনতে।
কেরানীগঞ্জের জিলা পরিষদ মার্কেটের নিউ শরীফ প্যান্ট প্লেসেস’র সত্ত্বাধিকারী মো. শারিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের নিজেদের কারখানা রয়েছে। সেখানে কাপড় কিনে প্যান্ট তৈরি করি। আমাদের সারা বছরই বিক্রি হয়। তবে ঈদকে কেন্দ্র করে বেচাবিক্রি অনেক বাড়ে। সারা বছরের মোট বিক্রির ৭০ শতাংশই ঈদের সময় হয়। করোনার কারণে গত দুই বছর আমাদের তেমন কোনো ব্যবসা ছিল না। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। করোনা পূর্ব সময়ের তুলনায় ৫০-৬০ শতাংশ বিক্রি হলেও ব্যবসায়ীক স্থবিরতা কেটেছে এতেই আমরা খুশি। বেচা বিক্রিও বেশ ভালো। ঈদকে কেন্দ্র করে আমাদের প্রথম ধাপের বিক্রি শেষ। দ্বিতীয় ধাপের বিক্রিও প্রায় শুরু হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তৈরি পোশাকের পাইকারি মার্কেটগুলোতে ঈদের বিক্রি শুরু হয়েছে শবে বরাতের কয়েক দিন আগে থেকেই। প্রথম ধাপের এই বিক্রি শেষ হয়ে কয়েক দিন বিরতি থাকে। তার পর প্রথম রোজা থেকে আবার বিক্রি শুরু হয়। পাইকারি মার্কেটগুলোতে ঈদের এই বিক্রি চলে ২০ রোজা পর্যন্ত। দেশের প্রতিটি জেলার খুচরা বিক্রেতারাই মূলত পাইকারি এসব মার্কেটের ক্রেতা। তারা কয়েক দফায় পোশাক কিনে নিয়ে ঈদের আগের দিন রাত পর্যন্ত বিক্রি করেন। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও কিছু উচ্চবিত্তরা এসব মার্কেটের থেকে সরবরাহ করা পোশাক কিনেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই তিন শ্রেণীর মানুষের পোশাকের চাহিদার ৬০-৭০ শতাংশই পূরণ হয় এসব মার্কেট থেকে। এসব মার্কেটে ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত দামের প্যান্ট, শার্ট, থ্রিপিস, বাচ্চাদেও পোশাক পাওয়া যায়। তবে এর উপরেও ১০০০-২০০০ টাকা দামেরও রয়েছে। সেগুলো সংখ্যায় কম।
কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতিও এ সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকদের মতে, পাইকারি বাজার ঘিরে এখানে প্রায় পাঁচ হাজার তৈরি পোশাকের কারখানা রয়েছে। অনেকের মতে এখানে তৈরি পোশাকের কারখানা ছয় থেকে সাত হাজার, আর দোকানের সংখ্যা নয় থেকে দশ হাজারের মধ্যে। এগুলোতে দুই থেকে আড়াই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ঘটেছে বলে তারা মনে করেন।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতিটি কারখানই মাসে কম বেশি এক কোটির টাকার পোশাক বিক্রি করেন। রোজার সময় এই বিক্রি বাড়ে। সে হিসেবে মাসে ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। যা গত দুই বছর হয়নি। এবার ঈদে পুরোটা পূরণ না হলেও অনেকটাই হবে বলে মনে করছেন তারা।
সদরঘাটের হকার্স মার্কেটে বিক্রি হয় ০-৬ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের জামা বিক্রি হয়। মার্কেটের সিফাত হোসিয়ারী এন্ড গার্মেন্টস এর একটি দোকানের ম্যানেজার মো. সবুজ বলেন, মার্কেটে আমাদের তিনটি দোকান রয়েছে। মাস দুয়েক আগ পর্যন্ত আমাদের প্রতিটিতে বিক্রি ছিল দিনে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। তবে শবেবরাতের পর থেকে আমরা ৭০-৮০ হাজার টাকা করে বিক্রি করছি। এখন এটি আরও বেড়েছে।
তবে এবার করোনা না থাকলেও ফেব্রিক্সের বাড়তি দাম কারখানা মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কিছুটা চাপে ফেলেছেন বলে জানিয়েছেন তারা। তারা বলছেন, ফেব্রিক্সের দাম বেড়ে যাওয়ায় পোশাকের তৈরির খরচ বেড়েছে। এতে বিক্রিও যতটুকু হওয়ার কথা ছিল ততটুকু হচ্ছেনা। কিছুটা কম হচ্ছে। এছাড়া অনেকের কাছে প্রয়োজনীয় পুঁজি না থাকায় চাহিদা মতো পণ্যও তৈরি করতে পারছেন না। আগের স্টক দিয়েই ব্যবসা করছেন। আগের মতো বাকির ব্যবসাও করতে পারছেননা ব্যবসায়ীরা। নগদ টাকায় কাচামাল এনে পোশাক তৈরি করতে হচ্ছে।
কেরানীগঞ্জের আলম টাওয়ারে শার্টের বড় বাজার। এই বাজারের হিমেল গার্মেন্টস এর মালিক মো এমদাদ হোসেন বলেন, আগে যে শার্টের কাপড় কিনতাম ১০৫ টাকা গজ এখন তা ১২০ টাকা লাগছে। প্যান্টের যে কাপড়ের দাম ছিল ২৫০ টাকা গজ এখন তা ৩৫০ টাকা কিনতে হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য খরচও বেড়েছে। ফলে পোশাক তৈরির খরচও বেড়েছে। এতে মুনাফার পরিমান সীমিত হয়ে এসেছে। তারপরও ব্যবসা যেহেতু ভাল হচেছ তাই আমরা খুশি।
কেরানীগঞ্জে দেখা হলো মো. রাশেদ নামের একজন খুচরা বিক্রেতার সঙ্গে। তিনি কুমিল্লার দেবিদ্বারের শেখ ব্রাদার্সের সত্ত্বাধিকারী। তিনি বলেন, এই নিয়ে আমি দ্বিতীয়বারের মতো পাইকারি বাজারে আসলাম। ঈদের আগের আরও একবার আসতে হবে। প্রতিবার আমি ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকার পণ্য কিনে নিয়ে যাই। আমাদের ঈদ বিক্রি এখনও তেমন শুরু হয়নি। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে বলে আশা করছি।