রফিকুল ইসলাম
দেশে নির্মাণ কাজ চলছে বড় বড় অবকাঠামো আর উন্নয়ন প্রকল্পের। যে কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ সামগ্রী বালির চাহিদা।
বাংলাদেশ স্যান্ড মাইনিং অ্যান্ড মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, ৫-৬ বছর আগে যেখানে বালির বাজার ছিল ৪০০ থেকে ৪৫০ কোটি টাকার, সেখানে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকায়। বর্তমানে এ খাতের বার্ষিক বৃদ্ধি ১০-১৫ শতাংশ।
খাত সংশ্লিষ্টরা দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, হাইওয়ে, অর্থনৈতিক অঞ্চল, বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, আধুনিক অফিস এবং আবাসিক ভবনের মতো মেগা প্রকল্পগুলো আকাশচুম্বী করে তুলেছে বালির চাহিদা।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বালি উত্তোলন করা হয়। বেশিরভাগই তোলা হয় পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা নদী থেকে। সেইসাথে কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী, পাবনা, মুন্সিগঞ্জ, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং সুনামগঞ্জের জেলা থেকেও এটি উত্তোলিত হয়ে থাকে।
এ এলাকাগুলোর মধ্যে পরিস্কার ও উন্নতমানের বালির অধিকাংশই আসে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা থেকে। নদী থেকে উত্তোলিত বালি দেশের চাহিদার শতভাগই পূরণ করে। ঢাকার সবচেয়ে বড় বালির বাজার ডেমরা, বসিলা, গাবতলী ও মিরপুরে।
স্টোন অ্যান্ড স্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রায় ৭-৮ লাখ মানুষ সরাসরি এ খাতে জড়িত। ভিটি বালি, আস্তর বালি এবং ঢালাই বালি- এ তিন ধরনের বালি বাংলাদেশে বেশি ব্যবহৃত হয়।
আমরা মেঘনার চাঁদপুর এলাকা থেকে ভিটি বালি, পদ্মার পাকশি এলাকা থেকে আস্তর বালি এবং সিলেট অঞ্চলের ঢালাই বালি উত্তোলন করি। ঢালাই বালি বা লাল বালি বিশেষ করে পাইলিং এবং কংক্রিট মেঝেতে ব্যবহৃত হয়।
আলিফ বিল্ডার্সের সত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আরও বলেন, আমাদের লাল বালির প্রায় ২৫ শতাংশই আসে সুনামগঞ্জের ফাজিলপুর এলাকা থেকে, আর ১৫ শতাংশ আসে সিলেটের গোয়াইনঘাট থেকে। কিছু বালু ময়মনসিংহ এবং নেত্রকোণার দুর্গাপুর এলাকা থেকেও আসে।
তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ব্রিজ এলাকা থেকে ঢাকার ডেমরা বাজার পর্যন্ত ১০০ নিবন্ধিত বালি ব্যবসায়ী রয়েছেন।
রাজধানীর গাবতলী এলাকার আরেক বালি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, গাবতলী বালুঘাট ঢাকার অন্যতম বালির বড় বাজার। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ থেকে ১ হাজার ট্রাক বালি বিক্রি হয়।
তিনি বলেন, আমরা এক ট্রাক আস্তর বালি ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকায় এবং সিলেটের বালি প্রতি ট্রাক ৮ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করি। ভিটি বালি ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকায় টাকায় বিক্রি হয়। নগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা এখানে প্রতিদিন বালি কিনতে আসেন।
এ খাতের চ্যালেঞ্জ
স্টোন অ্যান্ড স্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেন, নৌ পথে চাঁদাবাজি বালি ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চাঁদাবাজি আর পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় বালির দাম বেড়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, সিলেট থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রায় ১০-১৫ পয়েন্টে চাঁদা টাকা দিতে হয়। আমরা রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত-চাঁদাবাজ ও পুলিশকে প্রতি চালানে প্রায় ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা দেই। এছাড়া ইজারাদাররাও আমাদের কাছ থেকে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা দাবি করে।
গত দুই বছর ধরে, সরকার সিলেট অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বালি উত্তোলন এলাকাকে পর্যটন স্পট হিসেবে চিহ্নিত করায় সেখান থেকে বালি উত্তোলন বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে লাল বালির দাম বেড়ে যায়। কিন্তু জুন মাসে কোয়ারিতে পুনরায় কাজ শুরু হওয়ায় দাম এখন কমছে।
কোয়ারি থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ না করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান জাহাঙ্গীর। সেইসাথে চাঁদাবাজি বন্ধের দাবিও তাদের।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সঠিক তদারকির অভাবে এ খাত বিশৃঙ্খলা এবং অনিয়মের শিকার হচ্ছে। ফলে খনি থেকে উত্তোলন, এমন কি বালি বিক্রি পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
তারা জানান, সরকারের অনুমতি নেয়ার পর নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বালু উত্তোলন করতো খনি শ্রমিকরা। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সমর্থিত কিছু খনি শ্রমিক এখন যে কোন জায়গা থেকেই বালি উত্তোলন করছে; যা পুরো খাতকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বালি খনি ও বণিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, যেসব খনি শ্রমিক অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করছে তারা পুরো খাতের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। আমরা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কাছ থেকে অনুমতি নেয়ার পরেই বালি উত্তোলন করি।
তিনি বলেন, অনেক খনি শ্রমিক আছেন যারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই বালি উত্তোলন করছেন। এ অবৈধ পদক্ষেপ নদীর তীরে ভাঙন বাড়ছে। পরিবেশ রক্ষায় এ ধরনের অপরিকল্পিত খনন রোধে সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ারও আহ্বান জানান মসিউর রহমান।