রাজশাহীতে দিন দিন বাড়ছে মহিষ পালন। এতে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন এখানকার কৃষকরা। বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মহিষ পালনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার। ওই বিভাগের নদী ও চর ছাড়াও পরিত্যক্ত জমিতে খোলাভাবে পালন হতো মহিষ। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় কমেছে ওই সব চারণ ভূমি। ফলে এখন খামার করেই পালন করা হচ্ছে মহিষ।
এতে মহিষের খাবার যোগারে বাড়তি টাকা ব্যয় হলেও দুধসহ দূগ্ধজাত সামগ্রীর দামও বেড়েছে। ফলে মহিষের খামার এখনও লাভজনক। ওই মহিষ পালনকে কেন্দ্র করে চলছে কয়েক স্তরের জীবন-যাপন আর ব্যবসা যা আমাদের অর্থনীতির ওপর ফেলছে ব্যাপক প্রভাব।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজশাহীর লালপুর উপজেলার আড়ানী বাকনা চরে দেখা মেলে মহিষের খামার। স্থানীয় খামারীরা জানালেন, চরেই রয়েছে ১৫ টি খামার। যেখানে পালন করা হচ্ছে প্রায় ৩শ মহিষ।
কথা হয় মহিষ খামারী শিমুলের সাথে। তার খামারে রয়েছে ১০টি মহিষ। এরমধ্যে দুধ দিচ্ছে ৬টি ।
খামারী শিমুল জানান, ৬টির মধ্যে প্রতিটি মহিষ থেকে প্রতিদিন তিনি ৫-৭ লিটার দুধ পান। তিনি ওই দুধ ঘোষদের কাছে বিক্রি করেন। প্রতিদিন দুধ বিক্রি করে তিনি ১২শ থেকে ১৩শ টাকা পান তিনি। মহিষ পালন করে যাবতীয় খরচ বাদে তার প্রতিবছর ২ লাখ টাকা লাভ হয়।
দুধক্রেতা পঙ্কজ ঘোষ জানান, ওই এলাকায় মোট ৪ জন ঘোষ রয়েছেন তারা। প্রতিদিন স্থানীয় মহিষ খামারিদের কাছ থেকে দুধ কিনে তারা ক্রিম, ছানা ও ঘি তৈরী করে বিক্রি করেন। ক্রিম তৈরীর মেশিন তাদের নিজেদের রয়েছে। বাপ-দাদাদের আমল থেকে তারা ওই ব্যবসায় জড়িত।
তিনি জানান, সাধারণত ১ কেজি মহিষের দুধে ১৫০ গ্রাম ক্রিম পেলে তার দাম পরিশোধ করেন ৭০ টাকা। ক্রিম ছাড়া দুধের পাতলা অংশ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তারা ছানা তৈরি করেন। তারা প্রতিদিন ১০-১২ কেজি ক্রিম তৈরি করেন জানিয়ে আরো বলেন, ১কেজি ক্রিম থেকে ৪৫০ গ্রাম ঘি তৈরি হয়।
তিনি আরও জানান, জেলা ও জেলার বাইরে থেকে মিষ্টি দোকানিরা তাদের কাছ থেকে ছানা কিনে নিয়ে যায়। ওই ছানা দিয়ে রসগোল্লা, চমচম, কাঁচাগোল্লাসহ নানা মিষ্টি তৈরি হয়। এছাড়া ঘি ব্যাবসায়ীরাও তাদের কাছ থেকে ক্রিম কিনে নিয়ে যান দাবি করে তিনি বলেন, প্রতি কেজি ঘি তারা পাইকারি ৮শ, ক্রিম ৩শ ও ছানা বিক্রি করেন ১শ টাকায়।
নাটোর উত্তরা গণভবনের সামনের মিষ্টি বিক্রেতা শেফালী হোটেল ও মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম জানান, তারা ছানা দিয়ে রসগোল্লা, চমচম,কালোজাম, সুইটচিপসসহ বিভিন্ন মিষ্টি তৈরি করে বিক্রি করেন। ওই ছানাগুলো তারা লালপুরসহ বিভিন্ন স্থানের ঘোষদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন।
শহরের মাদ্রাসামোড় মাংস বাজারের ব্যবসায়ী সেলিম জানান, প্রতিদিন তারা একটি করে মহিষ জবাই শেষে মাংস বিক্রি করেন। খাসির মাংসের চেয়ে ওই মাংসের দাম কম বিধায় যারা গরুর মাংস পছন্দ করেন না তারা মহিষের মাংস কেনেন। প্রতি কেজি মাংস সাড়ে ৫শ থেকে ৬শ টাকায় বিক্রি হয় দাবি করে তিনি বলেন, প্রতিদিন একটি মহিষের মাংস বিক্রি করে খরচ বাদে তাদের ৩-৪ হাজার টাকা লাভ হয়।
দিঘাপতিয়া ঘোষপাড়ার ঘি ব্যবসায়ী ভোলা বলেন, তারা মহিষের দুধের ক্রিম কিনে এনে নিজ বাড়িতে ঘি তৈরির পর ১২শ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। এতে লাভ দিয়ে তাদের ৫-৬ সদস্যর সংসার ভালোভাবেই চলে যায়।
রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণীসম্পদ দপ্তরের পরিচালক ডাক্তার উত্তম কুমার দাস বলেন, রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলায় মোট ১ লাখ ২২ হাজার মহিষ পালন হচ্ছে।
এব্যাপারে জানতে চাইলে নাটোর জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার গোলাম মোস্তফা বলেন, নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়াসহ সকল উপজেলাতেই পালন করা হচ্ছে মহিষ। তবে সবচেয়ে বেশি মহিষ পালন করা হয় লালপুর উপজেলার বিভিন্ন চর আর পদ্মা নদীর পাড় সংলগ্ন গ্রামে।
এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, জেলায় মোট ৬১১টি মহিষের খামার রয়েছে। মোট মহিষের সংখ্যা ৭ হাজার ২৪৮ টি। এরমধ্যে লালপুর উপজেলায় সর্বোচ্চ খামার ৩৮০টি। ওই উপজেলায় পালন করা মোট মহিষের সংখ্যা ৫হাজার ৫০৮টি। জেলায় পালিত মহিষের মধ্যে দেশীয় প্রজাতীর বাইরে রয়েছে ভারতীয় মুরা(Murra) জাত।
রাজশাহী বিভাগীয় প্রাণীসম্পদ দপ্তরের পরিচালক ডাক্তার উত্তম কুমার দাস বলেন, রাজশাহীর প্রতি জেলায় মহিষের জাত উন্নয়নের কাজ চলছে। ভারতীয় জাতের সাথে দেশীয় জাতের মিশ্রণে জাত উন্নয়ন করা গেলে দুধের পরিমাণ বাড়বে। এতে খামারিরা যেমন আরো লাভবান হবেন, তেমনি নতুন নতুন খামারি তৈরী হবে। আর এটা হলে স্থানীয় মাংস, দুধ, ক্রিম, ছানা ও ঘি এর চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অংশ অন্য জেলায় বিক্রি করা যাবে। আর এটা করা গেলে তা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।