প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি কতটা সম্ভব?

আশরাফুল ইসলাম রানা
২৭ আগস্ট ২০২২ ১৩:৪৩:০৪ | আপডেট: ২ years আগে
রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি কতটা সম্ভব?

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) নিম্নমানের জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। তবে প্রস্তাবিত তেল ব্যবহারে গাড়ির ইঞ্জিনের ক্ষতি হবে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিপিসি বলছে, রাশিয়া নিম্ন গ্রেডের যে ডিজেল অফার করেছে তাতে উচ্চ মাত্রার সালফার (৫ হাজার পিপিএম) রয়েছে। ব্যারেল প্রতি এ ডিজেলের দাম ধরা হয়েছে ৫৭ ডলার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশের যানবাহনের জন্য এই গ্রেডের জ্বালানি উপযুক্ত নয়। এ ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করলে গাড়ির ইঞ্জিনের ক্ষতি হবে।

রাশিয়া জানিয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে যে ধরনের জ্বালানি তেল (ডিজেল) ব্যবহার করা হয়, তার চেয়ে উচ্চ গ্রেডের ডিজেল (১০-২০ পিপিএম) সরবরাহ করতে সক্ষম রাশিয়া।

তবে উচ্চ গ্রেডের ডিজেলে ল্যান্ডিং খরচ ব্যারেল প্রতি ১৬০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিপিসির জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২৪ আগস্ট শোধনাগার পরীক্ষার জন্য ৫০ কেজি অপরিশোধিত তেল পাঠিয়েছে রাশিয়া। যা চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডকে (ইআরএল) পাঠানো হয়েছে। তবে ইআরএলের কারিগরি দুর্বলতার কারণে এ তেল পরিশোধনের কোনো সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তামিম দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ‘৫ হাজার পিপিএম গ্রেডের ডিজেল একটি মারাত্মক রাসায়নিক পদার্থ। এটি ব্যবহার করলে গাড়ির ইঞ্জিনের ক্ষতি হবে। তবে এটি পাওয়ার প্ল্যান্টে ব্যবহার করা যেতে পারে।’

তিনি জানান, ১০ থেকে ২০ হাজার পিপিএম গ্রেডের ডিজেলে সাধারণত কোনো সালফার থাকে না। এ ধরনের ডিজেল বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল ১৩৭ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। এ সময়ে রাশিয়া যদি বিপিসির কাছে ব্যারেল প্রতি ১২০ ​​ডলারে বিক্রি করে, তবে এটি আমাদের জন্য লাভজনক হবে না। কারণ এটি বাংলাদেশে আনতে আরও ২০ ডলারের মতো খরচ হবে।

প্রযুক্তিগতভাবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে বিপিসি

গত ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় জ্বালানি তেল কেনার উপায় খুঁজে বের করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।

এর আগে, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানি ‘রোসনেফ্ট’ বিপিসিকে প্রতি ব্যারেল ডিজেল (৫ হাজার পিপিএম) ৫৭ ডলারে বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিলো।

প্রস্তাবে বিপিসি জনিয়েছে, এই গ্রেডের ডিজেল বাংলাদেশি মান অনুযায়ী কার্যত টেকসই নয়। তাই চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কুয়েত এবং থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের মানদণ্ড অনুযায়ী ৫০ পিপিএম ডিজেল আমদানি করা হয়।

এর পরে রোসনেফ্টসহ বেশ কয়েকটি রাশিয়ান প্রাইভেট কোম্পানি ১০ থেকে পাঁচ হাজার পিপিএমের বিভিন্ন গ্রেডের ডিজেল সরবরাহের জন্য আরেকটি প্রস্তাব পাঠায়। তবে এ প্রস্তাবে তারা নির্দিষ্ট কোন দাম নির্ধারণ করেনি বলে জানিয়েছেন বিপিসি।

বিপিসির পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড প্ল্যানিং) খালিদ আহমেদ ‘দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই করার জন্য বিপিসি একটি কমিটি গঠন করে। তারা প্রস্তাবের প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করছে। শনিবার রাশিয়ানদের সাথে অনলাইনে একটি বৈঠক করা হবে। বৈঠকে শিপিং, বীমা এবং অর্থপ্রদান নিয়ে আলোচনা হবে।’

বিপিসির আরেক কর্মকর্তা ‘দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, ‘রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং তাদের গ্রেড নিম্নমানের হওয়ায় শীঘ্রই আমদানি শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’

অপরিশোধিত তেল পরিশোধনে অক্ষম ইআরএল

বিপিসি বলেছে, পরিশোধিত তেল দেওয়ার আগে নিম্নমানের অপরিশোধিত তেলের প্রস্তাব করেছিল রাশিয়া। কিন্তু তেল পরিশোধন করতে ইস্টার্ণ রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) অক্ষমতার কারণে বিপিসি এটি কিনতে পারেনি।

এদিকে, ইআরএল শুধুমাত্র দুই ধরনের তেল পরিশোধন করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব থেকে আনা আরবিয়ান লাইট এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আসা মুরবানের অপরিশোধিত তেল।

ইআরএলের এক কর্মকর্তা শুক্রবার ‘দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ‘গত ২৪ আগস্ট শোধনাগারে পরীক্ষার জন্য ৫০ কেজি অপরিশোধিত তেল পাঠিয়েছে রাশিয়া। তেলগুলো এখনও বিমানবন্দর থেকে ছাড়া হয়নি। আমরা জানি না; কে এই চালানটি মুক্ত করবে। কিন্তু, ইআরএলে রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করা সম্ভব নয়।’

ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার তেল, গ্যাস ও কয়লা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু এর পরও ভারত ও চীন রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল আমদানি করছে। যা বৈশ্বিক বাজারের চেয়ে অন্তত ২০ ডলার কম দামে। আর এ দুই দেশ তেল আমদানি করার কারণ হচ্ছে- তাদের প্রয়োজনীয় পরিশোধন করার ক্ষমতা রয়েছে।

মূল্য পরিশোধ পদ্ধতি

রাশিয়ান জ্বালানি তেলে আমদানির ক্ষেত্রে দুটি প্রধান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- কীভাবে আমদানি বিল পরিশোধ করা হবে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় বাণিজ্যিক অংশীদারদের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হবে কিনা।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ‘দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইউরোপ ও আমেরিকা রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেলে কিনছে। সেজন্য বাংলাদেশও একই কাজ করলে সমস্যা হওয়ার কথা না। এ সময় বাংলাদেশ-রাশিয়ার জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে বিনিময় বাণিজ্যের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। তবে মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে চীন-ভারত যে পন্থা অবলম্বন করেছে সেটিও অনুসরণ করা সম্ভব।