আব্দুর রাজ্জাক সোহেল
ব্যক্তিগত কিংবা সম্পত্তির নিরাপত্তা নিয়ে এখন মানুষের মাঝে ক্রমশই বাড়ছে উদ্বেগ। আর এ কারণে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, খুবই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে ইলেকট্রনিক নজরদারি সিস্টেম তথা ক্লোজড-সার্কিট টেলিভিশনের (সিসিটিভি) ব্যবহার।
এতে, বাংলাদেশে বার্ষিক ৩০ শতাংশ বৃদ্ধির সাথে দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে নিরাপত্তা সরঞ্জামের বাজার।
নজরদারি সরঞ্জামগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহারের ফলে নতুন ব্যবসায়িক দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, যা দেশীয় উদ্যোক্তাদেরও এ জাতীয় পণ্য উৎপাদনে আগ্রহী করছে। যদিও এখন পর্যন্ত দেশীয় চাহিদার সিংহভাগই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।
ব্যাংক, হাসপাতাল, শিল্প, শপিং মল, আবাসিক হোটেল এবং কমবেশি সব ব্যবসা কেন্দ্রেসহ বাণিজ্যিক জায়গায় ক্লোজড-সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ব্যবহার অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
এছাড়াও, সরকার অফিস, শিল্প, ট্রাফিক সিগন্যাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিমানবন্দর এবং নিরাপত্তা বাড়াতে ঐতিহাসিক বা বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন প্রতিটি সম্ভাব্য স্থানে সিসিটিভি স্থাপনের দিকে নজর দিচ্ছে।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জরিপ অনুসারে, দুর্বল ডিজিটাল সিস্টেম, অবকাঠামো, ব্যক্তিগত ও পরিবেশগত নিরাপত্তা বিবেচনায় বিশ্বের সবচেয়ে অনিরাপদ ৭ শহরের মধ্যে রয়েছে ঢাকা। নিরাপদ শহরের তালিকা-২০২১ এ এসব বৈশিষ্ট্যযুক্ত ৬০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৫৪তম।
নিরাপত্তাহীনতায় নগরবাসীকে তাদের আবাসিক ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্থাপনে আগ্রহী করে তুলছে।
“অপরাধ প্রতিরোধে সিসিটিভি নজরদারির প্রভাব: ঢাকা সিটিতে একটি সমীক্ষা” শীর্ষক একটি জরিপে দেখা গেছে, অপরাধ শনাক্তকরণ ও প্রতিরোধে একটি বড় ভূমিকা রয়েছে সিসিটিভির।
সমীক্ষা অনুসারে, সিসিটিভি নজরদারি-যাকে “বিগ ব্রাদার সার্ভিল্যান্স” বলা হয়; এটি অপরাধীদেরকে সিসিটিভি স্থাপিত এলাকায় অপরাধ করা থেকে বিরত রাখে, যে কারণে তারা অন্য জায়গা বেছে নেয়, যেখানে এমন কোনো নজরদারি নেই৷
গবেষণা আরও উঠে আসে, সিসি ক্যামেরা অপরাধ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর; বিশেষত ব্যক্তি ও সম্পত্তির বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধ। এসব অপরাধের দৃশ্য রেকর্ড করার কারণে, চুরি বা ডাকাতি সনাক্ত করতেও সাহায্য করতে পারে।
রাজধানীর বায়তুল মোকাররমের নিউ সুপার মার্কেট থেকে ধানমন্ডির বাসিন্দা মোহাম্মদ শাজাহানকে সিসিটিভি কিনেছেন।
দ্য বিজনেস পোস্ট’র সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই তিনি তার বাড়িতে সিসিটিভি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তিনি বলেন, শহরে চোরেরা চব্বিশ ঘণ্টাই তৎপর। এছাড়াও, সচেতন ভাড়াটেরা ভাড়া নেয়ার সময় ভিজিল্যান্স ক্যামেরা আছে কি না তা জানতে চান।
নগরবাসীর পাশাপাশি করপোরেট হাউসগুলোও তাদের ব্যবসায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্থাপন করছে। এর মাধ্যমে তারা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দূর থেকেও পর্যবেক্ষণ করতে পারছেন।
চকবাজারে পাইকারি ব্যবসা করেন জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, তিনি তার অফিসে সব সময় উপস্থিত থাকতে পারেন না, যেহেতু তার অন্য ব্যবসা আছে। তাই তিনি তার অফিস বা বাসা থেকে সব ব্যবসা মনিটর করার জন্য সিসিটিভি বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এ ব্যবসায়ী বলেন, এ ধরনের সতর্কতা আমাকে ব্যবসার পাশাপাশি আমার কর্মীদের উপর নজর রাখতেও সহায়তা করে, আসলে নিজ নিজ দায়িত্ব তারা যথাযথভাবে পালন করছেন কি না?
নজরদারি সরঞ্জামের বাজার
বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক্স সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন বলছে, তাদের বর্তমান বাজারের আকার ৭০০ কোটি টাকা, এর বার্ষিক বৃদ্ধি ৩০ শতাংশ।
বায়তুল মোকাররম ও এলিফ্যান্ট রোডের বেশ কয়েকটি মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, নজরদারির সরঞ্জাম বিক্রি বাড়ছে।
এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডাহুয়া, হিকভিশন, জোভিশন, এভিটেক, ক্যাম্পরো এবং ভিটেক- দেশের কিছু সুপরিচিত ব্র্যান্ড। যেখানে পণ্যগুলোর দাম ১ হাজার টাকা থেকে ৪০ হাজার টাকার মধ্যে।
দেশে বছরে ৩ থেকে ৪ লাখ পিস সিসিটিভি দরকার। দেশীয় চাহিদা মেটাতে সরঞ্জাম আমদানিতে বাংলাদেশ চীনের ওপর খুবই নির্ভরশীল। এছাড়া পর্তুগাল, তাইওয়ান ও হংকং থেকে কিছু পণ্য আমদানি করা হয়।
সমিতির কোষাধ্যক্ষ মোঃ মাহমুদ-ই-খোদা বলেন, আগে বাণিজ্যিক জায়গায় সিসিটিভি ব্যবহার করা হলেও এখন সেগুলো নগর জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, মূল্য হ্রাস এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি বাজারকে বাড়িয়ে তুলছে। গত ১৫ বছরে দাম ৬০ শতাংশ কমেছে।মাত্র ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা গ্রাহকরা তাদের মোবাইল ফোনে সিসিটিভি ব্যবহার করতে পারেন।
বিক্রমপুর ক্যামেরা হাউসের ব্যবস্থাপক শেখ নাজিম উদ্দিন বলেন, ক্রেতারা মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকায় সিসিটিভি পেতে পারেন যা এক দশক আগেও স্বপ্ন ছিল।
তার মতে, কম দাম এবং নিরাপত্তার উদ্বেগের কারণে মনিটরিং ডিভাইসের দিকে এখন ঝুঁকছে নগরবাসী।
এলিফ্যান্ট রোডের বেস্ট সিকিউরিটির রাহাতুল ইসলাম বলেন, ডাহুয়া, হিকভিশন সেরা মানের ক্যামেরা, যেগুলোর দাম ১ হাজার টাকা থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
এছাড়াও, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অধিকাংশ জন সমাগমের জায়গায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সিসিটিভি স্থাপন করেছে।
ডিএমপির লজিস্টিক, প্রকিউরমেন্ট এবং ফিন্যান্স বিভাগের তথ্যানুসারে, বর্তমানে ডিএমপি ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা পরিচালনা করছে এবং পুরো শহরকে নজরদারি নেটওয়ার্কের আওতায় আনার জন্য আরও ১ লাখ ক্যামেরা স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
দেশীয় উৎপাদন কেন পিছিয়ে?
৭০০ কোটি টাকার সিসিটিভি বাজার থাকলেও দেশীয় উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানি পণ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না।
ওয়ালটনের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: লিয়াকত আলী বলেন, তারা নজরদারি পণ্যের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন, এবং শীঘ্রই সেগুলো বাজারে আনার পরিকল্পনা করছেন।
তিনি দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই পণ্যের নকশা চূড়ান্ত করেছি এবং সিসিটিভি উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত। আমি আশা করি, আমরা আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে এটি বাজারজাত করতে সক্ষম হবো।
ইলেকট্রনিক্স সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রচার সম্পাদক জাকির উদ্দিন আহমেদের মতে, বাজারে অসম প্রতিযোগিতার কারণে অনেক উদ্যোক্তা নজরদারি সরঞ্জাম তৈরি করতে উৎসাহ বোধ করেন না।
তিনি বলেন, তবে এখন কেউ কেউ এটি দেশেই উৎপাদন করার পরিকল্পনা করছেন। শীঘ্রই দেশ এ ব্যাপারে একটি ইতিবাচক ফলাফল দেখবে।