আরিফুর রহমান তুহিন
করোনা মহামারির ধাক্কা কিছুটা সামলে যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন পোশাক রপ্তানিকারকরা ঠিক তখনই সুতার দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন টেক্সটাইল মিল মালিকরা। এতে বিদ্যমান কার্যাদেশ পূরণে নতুন করে সমস্যায় পড়েছেন পোশাক রপ্তানিকারকরা।
তাদের দাবি, টেক্সটাইল মিল মালিক ও পোশাক রপ্তানিকারকদের মধ্যে পূর্বের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে দাম বাড়িয়েছেন সুতা উৎপাদনকারীরা।
পোশাক ও টেক্সটাইল উৎপাদনকারীদের মধ্যে পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি পাউন্ড তুলার দাম ১ ডলার ছাড়িয়ে গেলে সুতার দাম আলোচনার মাধ্যমে পুনারায় নির্ধারণ করা হবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম দ্য বিজনেস পোস্ট’কে জানান, সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে বেআইনিভাবে এবং অযৌক্তিকভাবে দাম ৪.২ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫ ডলার করেছেন সুতা উৎপাদনকারীরা। এ অবস্থায় আমরা তাদের আলোচনায় বসতে বলেছিলাম, কিন্তু তারা তাতে সাড়া দেননি।
তিনি বলেন, আমরা প্রতি কেজি সুতার মূল্য ৪.২ ডলারের ভিত্তিতে পণ্যের দাম নির্ধারণ করেছি, কিন্তু স্পিনিং মিল মালিকরা কোনো ঘোষণা ছাড়াই দাম বাড়িয়েছেন। এখন ক্রেতারা দাম সমন্বয় করতে চাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান ও টেক্সটাইল মিলের মালিক, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, সমস্যাটি সমাধানযোগ্য।
তিনি বলেন, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ আলোচনা করলে সব সমস্যার সমাধান হবে। তারা আমাকে কয়েক মাস আগে সুতার দাম নিয়ে আলোচনা করার জন্য অনুরোধ করেছিল এবং আমরা বৈঠকের পরে একটি সমাধান পেয়েছি। যদি তারা এখন আমাকে ডাকে, আমি আবারও মধ্যস্থতা করতে রাজি।
কেন তিনি নিজে এ কাজ করছেন না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এটা পারি না। কারণ, আমি বিটিএমএ, বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ-তে কোনো অফিসিয়াল পদে নেই।
প্রতি পাউন্ড তুলার দাম করোনার আগে ০.৫৯ থেকে ০.৭ ছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে কম সরবরাহের কারণে দাম বাড়তে শুরু করে। দ্য ইকোনমিস্টের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে দাম প্রায় ৮০ শতাংশ বেড়েছে।
নাসডাকের তথ্যানুসারে, প্রতি পাউন্ড তুলার দাম ২৮ সেপ্টেম্বরে ১ ডলার থেকে ১৭ নভেম্বর প্রায় ১.২০ ডলারে পৌঁছায় এবং এটি গত এক দশকের মধ্যে নতুন রেকর্ড।
নাসডাকের তথ্য বলছে, গত ২২ নভেম্বর তুলার দাম কমতে শুরু করে এবং ২ ডিসেম্বরে প্রতি পাউন্ড ১.০২ ডলারে পৌঁছায় ৷ কিন্তু প্রতি পাউন্ড তুলা বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ১.০৬-১.০৮ ডলারে বিক্রি হচ্ছে৷
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগস্টে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি পাউন্ড তুলা বিক্রি হয় ০.৯-০.৯৬ ডলারে এবং স্পিনিং মিল মালিকরা প্রতি কেজি সুতার দাম ৪.৫ বা তারও বেশি বাড়িয়েছে। তারা প্রতিদিন দাম পরিবর্তন করেন, এমনকি আগে থেকে বরাদ্দ করা সুতারও।
বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ সমস্যা সমাধানে বিটিএমএকে আলোচনা করতে বলেছে। তারা ২১ আগস্ট একটি বৈঠকের আয়োজন করে, যেখানে কুতুবউদ্দিন মধ্যস্থতা করেন। সভায় একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, টেক্সটাইল মিল মালিকরা প্রতি কেজি ৩০-কার্ডেড সুতার জন্য ৪.২ ডলার পাবেন, যদি বৈশ্বিক বাজারে তুলার দাম প্রতি পাউন্ড ০.৮৫ থেকে ১ ডলারের মধ্যে থাকে। কিন্তু যদি তুলার দাম পাউন্ড প্রতি ১ ডলার ছাড়িয়ে যায়, তিনটি পক্ষ আবার নতুন মূল্য সীমা ঠিক করতে বসবে।
পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন, ২৮ সেপ্টেম্বর তুলার দাম ১ ছাড়িয়েছে এবং সেই সময় বিটিএমএ তাদের আশ্বস্ত করেছিল যে, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সুতার দাম বাড়বে না। বিটিএমএ আরও বলেছে যে ৩০ নভেম্বরের পরে আলোচনার মাধ্যমে নতুন দাম নির্ধারণ করা হবে।
বিকেএমইএ-এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট ফজলি শামীম এহসান দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, তবে তারা কোনো নোটিশ ছাড়াই এবং পূর্বের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে প্রতি কেজি সুতার দাম ৫ ডলার করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, প্রতি পাউন্ড তুলার দাম বর্তমানে ১.০৬ ডলার এবং ডিসেম্বরের শুরু থেকে একই রয়ে গেছে। তাহলে, স্পিনিং মিল মালিকরা কিভাবে প্রতি কেজি সুতার দাম ০.৬ ডলার বাড়িয়েছে?
শীঘ্রই দাম খুব একটা কমবে না
করোনা থেকে পুনরুদ্ধারের সময়কালে বিশ্বব্যাপী তুলা উৎপাদন বেড়েছে। গ্লোবাল মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে উৎপাদন ৮.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৬.৫২ মিলিয়ন টনে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪.৪২ মিলিয়ন টন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৬.৪৩ মিলিয়ন টন ছিল। কিন্তু একই সময়ে বাংলাদেশ, তুরস্ক ও ভিয়েতনামে কাপড় রপ্তানি বৃদ্ধির কারণে বৈশ্বিক তুলার চাহিদা বেড়েছে।
সে কারণে স্বল্প সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক তুলার দাম সামান্য কমে আসবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। তবে তারা আশঙ্কা করছেন, ২০২৩ সালের আগে দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে না আসার।
হাতেম বলেন, আগামী জানুয়ারি থেকে দাম কমবে। তবে এ দাম করোনার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।
আংশিক চালানের অনুমতি চান পোশাক প্রস্তুতকারীরা
দেশের বর্তমান সুতার মূল্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে পোশাক রপ্তানিকারকরা এখন দাম কম থাকায় ভারত থেকে সুতা আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আংশিক চালানে বাধার কারণে তারা সহজে এবং অল্প সময়ের মধ্যে আমদানি করতে পারছেন না। পোশাক রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, তারা একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বার বার এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করলেও, তাতে কোনো সাড়া পাননি।
পোশাক রপ্তানিকারকরা আরও বলেন, বর্তমানে ভারতে প্রতি কেজি সুতার দাম ৩.৮-৩.৯ ডলার, যা দেশের বাজারের তুলনায় অনেক সস্তা।
হাতেম বলেন, সরকার আমাদের আংশিক চালানের অনুমতি দিলে আমরা সহজে এবং দ্রুত সুতা আমদানি করতে পারব। আমি কয়েকদিন আগে এনবিআর চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেছি এবং তিনি আমাকে বিজিএমইএ এবং বিটিএমএ কর্মকর্তাদের সাথে তার কাছে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু সমস্যা হল বিটিএমএ আংশিক চালানের অনুমতি চায় না।
কুতুবউদ্দিন বলেন, সরকার যদি মনে করে আংশিক চালান এ খাত ও দেশের জন্য সহায়ক, তাহলে তাদের অনুমতি দেয়া উচিত।