প্রচ্ছদ ›› বাণিজ্য

ইলেকট্রনিক্স পণ্য

হোম অ্যাপ্লায়েন্স রপ্তানিতে এগিয়েছে বাংলাদেশ

০৫ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:২৬:৩৬ | আপডেট: ৩ years আগে
 হোম অ্যাপ্লায়েন্স রপ্তানিতে এগিয়েছে বাংলাদেশ

ইব্রাহিম হোসেন অভি

একসময় ইলেকট্রনিক পণ্যের জন্য পুরোপুরি আমদানির উপর নির্ভরশীল ছিল বাংলাদেশ। তবে বর্তমানে বৈশ্বিক বাজারে টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর ও ওয়াশিং মেশিনের মতো হোম অ্যাপ্লায়েন্সের রপ্তানিকারকে পরিণত হতে শুরু করেছে দেশটি। বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানি করে ২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

উল্লিখিত তিনটি পণ্য ছাড়াও ফ্রিজার, বেভারেজ কুলার, এয়ার কন্ডিশনার, ব্লেন্ডার, রাইস কুকার, বৈদ্যুতিক পাখা, ল্যাপটপ, গ্যাসের চুলা, কম্প্রেসার এবং মোবাইল ফোন রপ্তানি করছে বাংলাদেশ।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে, যা এর আগের বছরের তুলনায় ১ হাজার ২৭৫ শতাংশ বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইলেকট্রনিক পণ্যের রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের আয়ের পরিমাণ ছিল ১.৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বিগত অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০.৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এসেছে রেফ্রিজারেটর থেকে। এছাড়া টেলিভিশন থেকে ৬.৪২ মিলিয়ন এবং এয়ার কন্ডিশনার থেকে এসেছে২.২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

এই সময়কালে ১.১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ফ্রিজার রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এছাড়াও রপ্তানিকৃত ইলেকট্রিক পণ্যের মধ্যে রয়েছে ২ লাখ ৭৯ হাজার ৬৫৭ মার্কিন ডলারের ওয়াশিং মেশিন, ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৩২ মার্কিন ডলারের ব্লেন্ডার, ১ লাখ ৫০ হাজার ৮৯৫ মার্কিন ডলারের গ্যাসের চুলা, ৩ লাখ ১৭ হাজার ৬৭৩ মার্কিন ডলারের রাইস কুকার, ৪ লাখ ২৪ হাজার ৭৯০ মার্কিন ডলারের বৈদ্যুতিক পাখ, ১৩ হাজার ৬০৩ মার্কিন ডলারের ল্যাপটপ এবং ২ লাখ ৫০ হাজার ৮২৮ মার্কিন ডলারের মোবাইল ফোন।

বর্তমানে ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, পূর্ব তিমুর, মেক্সিকো, রোমানিয়া, গ্রীস এবং অন্যান্য দেশে পণ্য রপ্তানি করছে স্থানীয় ইলেকট্রনিক্স শিল্পের জায়ান্ট ওয়ালটন।

কী আছে এই বৃদ্ধির পিছনে?

ইলেকট্রনিক শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দ্য বিজনেস পোস্টকে জানিয়েছেন, রপ্তানিতে নীতিগত সহায়তা এবং নগদ প্রণোদনা, সেইসাথে কর মওকুফ, স্থানীয় এবং বৈশ্বিক বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে খাতটিকে ব্যাপক সাহায্য করেছে।

বর্তমানে উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য যেমন এইচসিএফসি-ফ্রি রেফ্রিজারেটর এবং ইলেকট্রনিক পণ্যসহ অন্যান্য হোম অ্যাপ্লায়েন্সেস রপ্তানির বিপরীতে ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা ভোগ করে।

এছাড়াও আগামী ১১ বছরের জন্য এয়ার কন্ডিশনার, ফ্রিজার, রেফ্রিজারেটর, কম্প্রেসার এবং মোটরসাইকেল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কর্পোরেট কর কমিয়ে ১০ শতাংশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

এ প্রসঙ্গে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মুর্শেদ বলেন, “মানুষের মন জয় করে বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশের পথ সুগম করতে ইলেকট্রনিক্স অঙ্গনে একটি ব্র্যান্ড তৈরি করা আমাদের স্বপ্ন ছিল।”

“আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল আমদানি নির্ভরতা হ্রাস করা এবং দেশীয় উত্স থেকে ইলেকট্রনিক্স পণ্য এবং গৃহস্থালীর সরঞ্জামের চাহিদা পূরণে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা। আমরা আমাদের এ লক্ষ্য প্রায় অর্জন করেছি।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা ইলেকট্রনিক পণ্য উত্পাদন করে বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে চেয়েছিলাম এবং আমরা তা করেছি। কারণ দেশীয় বাজার এখন স্থানীয় ব্র্যান্ডে পরিপূর্ণ।”

“অভ্যন্তরীণ বাজারে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর আধিপত্য রয়েছে। এখন আমাদের লক্ষ্য হলো- ২০৩০ সালের মধ্যে শীর্ষ পাঁচটি বৈশ্বিক ইলেকট্রনিক ব্র্যান্ডের একটিতে পরিণত হওয়া। লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা রপ্তানি বাজারগুলোতে ফোকাস করছি। ক্রেতাদের কাছ থেকেও আমরা বেশ ভালো সাড়া পেয়েছি।”

মুর্শেদ আরও বলেন, আগামী বছরের মধ্যে ইলেকট্রনিক্স খাত থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ১০০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। এটা সম্ভব কারণ আমরা আন্তর্জাতিক মানের পণ্য উৎপাদন করছি এবং নায্য মূল্যে ক্রেতাদের হাতে এটি পৌঁছে দিচ্ছি।

রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, বেভারেজ কুলার, এয়ার কন্ডিশনার, টেলিভিশন, ওয়াশিং মেশিন, ব্লেন্ডার, গ্যাসের চুলা, রাইস কুকার, বৈদ্যুতিক ফ্যান, ল্যাপটপ, কম্প্রেসার এবং মোবাইল ফোনের মতো হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য রপ্তানি করছে ওয়ালটন।

মুর্শেদ বলেন, “আমরা আরও আফ্রিকান-এশীয় দেশের দিকে ফোকাস করতে চাচ্ছি। কারণ এই বাজারগুলো বৃদ্ধি পাওয়ার একটি বড় সুযোগ রয়েছে।”

বাংলাদেশের জন্য এর মানে কি?

ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “বাংলাদেশ যেহেতু এখন রপ্তানি বহুমুখীকরণে মনোযোগী, তাই ইলেকট্রনিক্স রপ্তানিতে দ্রুত প্রবৃদ্ধি দেশের জন্য একটি ভালো লক্ষণ।”

“এটি আমাদের শিল্পোয়নকে নির্দেশ করে– নিম্ন প্রান্ত থেকে উচ্চ প্রান্তের পণ্য পর্যন্ত। বাংলাদেশ ক্রমশ প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পে পা রাখছে। প্রযুক্তি-ভিত্তিক খাতে রপ্তানির ক্রমবর্ধমান প্রবণতা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করতে এবং নতুন যৌথ বিনিয়োগের সুযোগ উন্মুক্ত করতে সাহায্য করবে।”

কয়েকটি সুপারিশ জানিয়ে মোয়াজ্জেম বলেন, “রপ্তানি সম্প্রসারণের জন্য আমাদের আরও চ্যানেল তৈরি করতে হবে। এই মুহুর্তে, ওয়ালটন যা করছে তা অন্যান্য নির্মাতাদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া উচিত।”

“সরকারকে আরও প্রণোদনা এবং নীতিগত ব্যবস্থা নিয়ে আসা উচিত। প্রবৃদ্ধির পথটা সহজ ছিল না। তবে সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত নীতিগত সহায়তা এই সেক্টরে থাকা বাধাগুলোর কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।”

তিনি আরও বলেন, “সরকারের নীতি প্রবৃদ্ধির পক্ষে। আমাদের আরও প্রবৃদ্ধির জন্য বিদ্যমান বাণিজ্য সুবিধার ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। নগদ প্রণোদনা এবং উৎপাকদের জন্য কর কমানো দেশি ও বিদেশি বাজারে এই শিল্পের আরও বিকাশের জন্য দুর্দান্ত একটি প্রণোদনা।

“রপ্তানি বৃদ্ধি করার জন্য আমাদের লক্ষ্য বিদেশে নতুন বাজার অন্বেষণ করা এবং গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে পণ্যে বৈচিত্র্য আনা। এ লক্ষ্যে সরকারের উচিত সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান এবং বাংলাদেশকে ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানিকারক হিসেবে ব্র্যান্ডে পরিণত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।”

বাংলাদেশ যদি একটি একক খাতে তার রপ্তানি নির্ভরতা কমাতে চায় তবে তৈরি পোশাক শিল্প, হাই-ভ্যালু টেক-ভিত্তিক পণ্যগুলো দেশের পরবর্তী লক্ষ্য হওয়া উচিত।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “অর্থনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ সময়ের সাথে বিকশিত হয়। বর্তমানে রপ্তানি-নেতৃত্বাধীন অর্থনীতি হিসেবে, তৈরি পোশাক শিল্প দেশের সর্বোচ্চ অবদান রেখেছে, যা টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে একটি দুর্বলতা।

“এখন সময় এসেছে স্বল্পমূল্যের পণ্য থেকে উচ্চমূল্যের পণ্যের দিকে যাওয়ার। আমরা যদি ভিয়েতনামের রপ্তানি পণ্যের দিকে তাকাই, আমরা দেখতে পাব যে তাদের একটি বৈচিত্রপূর্ণ পোর্টফোলিও রয়েছে। এটা দেশটিকে তাদের রপ্তানি আয় প্রসারিত করার সুযোগ দিয়েছে।”

দ্য বিজনেস পোস্টকে তিনি বলেন, ইলেক্ট্রনিক্স এবং অন্যান্য রপ্তানির বর্তমান প্রবণতা যাতে অব্যাহত থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের যা যা করা দরকার তা অবশ্যই করতে হবে, যা আমাদের নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে।

দেশীয় বাজার

বাংলাদেশে ব্যবসায়িক তথ্যের উৎস ডাটাবিডি.কো অনুসারে, ২০২০ সালে দেশের স্থানীয় ভোক্তা ইলেকট্রনিক্স বাজার ছিল ৩.১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে ২০২৫ সালের মধ্যে এর পরিমাণ ৫.১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ওয়ালটন, ভিশন, মিনিস্টার, মাই চয়েস, যমুনা এবং নোভা বর্তমানে বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী তৈরি ও সংযোজন করছে। এর মধ্যে ওয়ালটন বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক পণ্য বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে।

সনি, স্যামসাং, সিঙ্গার, এলজি, প্যানাসনিক, তোশিবা এবং ফিলিপসের মতো বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোকে প্রতিস্থাপন করে স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছে।

স্থানীয় টেলিভিশন মার্কেটের প্রায় ২৫ শতাংশ শেয়ার ওয়ালটনের দখলে রয়েছে। মিনিস্টারের ৩ শতাংশ, ভিশনের ২ শতাংশ এবং যমুনার ১.৫ শতাংশ মার্কেট শেয়ার দখলে রয়েছে।

অন্যদিকে স্যামসাং ১১ শতাংশ, সিঙ্গার ৯ শতাংশ, সনি ৫ শতাংশ এবং এলজির ৪ শতাংশ মোট বাজার শেয়ার রয়েছে।