মেহেদী আল আমিন
গত অর্থবছরে শীর্ষ পাঁচ সবজির উৎপাদন বেড়েছে। যা বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট সবজির প্রায় ৬০ শতাংশ।
দ্য বিজনেস পোস্ট'কে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) সূত্র জানিয়েছে, এই প্রবৃদ্ধিতে ভর করে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মোট সবজি উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.৬১ মিলিয়ন টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের সবজি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৮.৯০ মিলিয়ন টন।
অর্থাৎ এক বছরে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ২.৭১ মিলিয়ন টন।
এই সময়ের মধ্যে সবজি চাষে প্রায় ১.২৭ লাখ হেক্টর নতুন জমি যোগ করেছে বাংলাদেশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪.৩৪ লাখ হেক্টর। আর তাতে হেক্টর প্রতি সবুজ সবজির ফলন প্রায় একই (২২ টন) রয়ে গেছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
আলু
বর্তমানে উৎপাদন তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে আলু। এমনকি আলুর উৎপাদনের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে আলু উৎপাদনের পরিমাণ ১১২.২৫ লাখ টন ছুঁয়েছে। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৪.৭৯ লাখ টন।
এদিকে হেক্টর প্রতি আলুর ফলন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩.২৫ টন। আর আগের বছর হেক্টর প্রতি আলুর ফলন ছিল ২৩.২২ টন। এই সময়ের মধ্যে আলু চাষে নতুন করে ১৯ হাজার ৯৭২ হেক্টর নতুন জমি যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে ৪ লাখ ৮২ হাজার ৬৬৬ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হয়ে থাকে।
আলু উৎপাদন সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানিয়ে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, “দেশে উৎপাদিত সবজির বড় অংশ আলু।”
তিনি বলেন, “তবে আমরা রপ্তানি মানের আলু উৎপাদন করি না। তাই আমাদের অবশ্যই ভালো মানের এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জাতের আলুর চাষ নিশ্চিত করতে হবে।”
বেগুন
শীর্ষ উৎপাদিত সবজির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বেগুন। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে বেগুন উৎপাদনের পরিমাণ ২৮.৮৯ লাখ টনে পৌঁছেছে। ১.০৯ লাখ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত হয়েছে এই বেগুন। এর আগের বছর ৯৩ হাজার ৫৯৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত বেগুনের পরিমাণ ছিল ২৪.৬৬ লাখ টন।
গত অর্থবছরে প্রায় ১৫ হাজার ৭৫৫ হেক্টর জমিতে বেগুন উৎপাদন করেছে বাংলাদেশ। সেই হিসেবে প্রতি হেক্টরে বেগুনের ফলন ২৬.৩৫ টন থেকে বেড়ে ২৬.৪১ টন হয়েছে।
টমেটো
চলতি অর্থবছরে দেশে ১৭.৮৮ লাখ টন টমেটো উৎপাদিত হয়েছে। এই হিসেবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে ৩৭ হাজার ৭০১ টন। বর্ধিত টমেটো চাষ করার জন্য ২ হাজার ৮৮৪ হেক্টর নতুন জমি যোগ করেছেন চাষীরা। এ নিয়ে টমেটো চাষে ব্যবহৃত মোট জমির পরিমাণ দাড়িয়েছে ৬০ হাজার ৭৬০ হেক্টর।
টমেটোর মোট উৎপাদন বাড়লেও হেক্টর প্রতি ফলন কিছুটা কমেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতি হেক্টর জমিতে টমেটোর ফলন ছিল ৩০.২৩ টন। তবে চলতি অর্থবছরে হেক্টর প্রতি ফলন দাঁড়ায় ২৯.৪২ টন।
মূলা
২০২০-২১ অর্থবছরে মূলার উৎপাদনের পরিমাণ ২.৬৫ লাখ টন বেড়ে ১৭.৬৯ লাখ টনে পৌঁছেছে। মূলা চাষে প্রায় ৫২ হাজার ৭২৬ হেক্টর জমি ব্যবহার করেছেন চাষীরা। যা বিগত বছরের তুলনায় ২ হাজার ৬৬৮ হেক্টর বেশি।
এসময় হেক্টর প্রতি ফলনও ৩৩.৫৫ টনে উন্নীত হয়েছে। এর আগের বছর হেক্টর প্রতি মূলার ফলন ছিল ৩০.০৫ টন। এমনকি লাউকে পেছনে ফেলে দেশের চতুর্থ সর্বাধিক উৎপাদিত সবজির স্থানটিও দখল করে নিয়েছে মূলা।
লাউ
২০২০-২১ অর্থবছরে লাউ উৎপাদনের পরিমাণ, প্রতি হেক্টর জমিতে ফলন এবং লাউ চাষ করা জমির পরিমাণ গত বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছর বাংলাদেশের ৬০ হাজার ২০৩ হেক্টর জমিতে ১৭.৪৪ লাখ টন লাউ উৎপাদিত হয়েছে।
এসময় উৎপাদন বেড়েছে ২.০৭ লাখ টন। চলতি বছর লাউ চাষে ৫ হাজার ৫৫৯ হেক্টর জমি সংযুক্ত করেছেন চাষীরা। প্রতি হেক্টরে জমিতে লাউয়ের ২৮.১১ টন থেকে বেড়ে ২৮.৯৬ টনে উন্নীত হয়েছে।
উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও দেশের মোট উৎপাদিত সবজিতে এসব সবজির সম্মিলিত পরিমাণ কিছুটা কমে গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের মোট সবজি উৎপাদনের ৬২ শতাংশই এই ৫ সবজির দখলে ছিল। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে সেই হার ৬১ শতাংশে নেমে এসেছে।
‘সংরক্ষণ সুবিধা বাড়ান’
এ খাতকে কীভাবে আরও উন্নত করা যায় সে বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, “বাংলাদেশকে সংরক্ষণের সুবিধা বাড়াতে হবে। কেননা দেশে কোল্ড চেইন নেটওয়ার্ক খুবই দুর্বল।”
“তবে সরকার গুণমান পরীক্ষা, গুণমান নিশ্চিতকরণ এবং সংরক্ষণের জন্য কোল্ড চেইন সুবিধা বৃদ্ধি করার জন্য কাজ করছে। গুণমান, প্রাপ্যতা এবং চমৎকার সংরক্ষণের সুবিধাই বিশ্ব বাজারে প্রবেশের পূর্বশর্ত।”
কিছু সবজি সারা বছরই দেশের বাজারে পাওয়া যায় এবং ভোক্তাদের মধ্যে এসব সবজির চাহিদাও বেশি।
বিজনেস পোস্ট'র সঙ্গে আলাপকালে রাজধানী ঢাকার শেওড়াপাড়া এলাকার খুচরা সবজি বিক্রেতা মোহাম্মদ সুমন বলেন, “আমরা পাইকারি বাজার থেকে সবজি কিনে আনি এবং তারা প্রতিদিন কিছু সাধারণ সবজি নিয়ে আসে।
“আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, মূলা, টমেটো, কাচা মরিচ, ধনিয়া, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, শসা এবং গাজর সবজির দোকানে বেশি বিক্রি হয়ে থাকে। এসব সবজির অধিকাংশই শীতকালে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায় এবং গ্রীষ্মকালে এসব সবজির বৈচিত্র্য সীমিত।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ৩৪ ধরণের সবজির তথ্য রাখে। কিন্তু এসব সবজির বাইরেও কয়েক ধরণের সবজি দেশে উৎপাদিত হয়ে থাকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এসব সবজির সম্মলিতি উৎপাদনের পরিমাণ ৬.২১ লাখ টনে পৌঁছেছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের সহযোগিতায় বায়োডাইভারসিটি ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্টিস্টের গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী ১ হাজার ৯৭টি প্রজাতির সবজি চাষ করা হয়।
এসব প্রজাতির ৭ শতাংশেরও কম সবজির সাথে পরিচিত বাংলাদেশ। এ গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, টমেটো, বেগুন, পেঁয়াজ, গাজর, বীট, লেটুস এবং ব্রকোলির মতো ফসলের উপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যাপী খাদ্যগুলো আরও অনুরূপ হয়ে উঠছে।
সবচেয়ে কম উৎপাদিত ৫ সবজি
দেশে সবচেয়ে কম উৎপাদিত পাচটি সবজি হলো- শালগম শাক, মটর, কচু, ধনিয়া এবং চিচিঙ্গা।
২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৩৬ হেক্টর জমিতে ২৩ হাজার ৬৬২ টন শালগম শাক উৎপাদন করেছে বাংলাদেশ। এসময় হেক্টর প্রতি ফলনের পরিমাণ ছিল ১৪.৪৬ টন।
একই সময় হেক্টর প্রতি ৯.০১ টন ফলনসহ ৩ হাজার ১১৪ হেক্টর জমিতে ২৮ হাজার ৮২ টন মটর উৎপাদন করা হয়।
এসময় হেক্টর প্রতি ১৯.৩১ টন ফলনসহ ১ হাজার ৭১৫ হেক্টর জমি মিলিয়ে ৩৩ হাজার ১২১ টন কচু উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া একই অর্থবছরে ৯ হাজার ২৪২ হেক্টর জমিতে ৩৪ হাজার ৭২২ টন ধনিয়া উৎপাদন করা হয়। অর্থাৎ প্রতি হেক্টর জমিতে উৎপাদনের পরিমাণ ৩.৭৫ টন।
তালিকার পঞ্চম অবস্থানে থাকা চিচিঙ্গা উৎপাদিত হয়েছে ৪০ হাজার ৩৯৮ টন। ২ হাজার ৬১৪ হেক্টর জমিতে এই ফলন হয়েছে। সে হিসেবে প্রতি হেক্টর জমিতে চিচিঙ্গার ফলন ছিল ১৫.৪৫ টন।