প্রচ্ছদ ›› অপরাধ

আঙুল ফুলে কলাগাছ বৈদ্যুতিক মিটার রিডার!

আশরাফুল ইসলাম রানা
০৪ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৩১:২২ | আপডেট: ২ years আগে
আঙুল ফুলে কলাগাছ বৈদ্যুতিক মিটার রিডার!

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লিমিটেডের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি একেএম রফিকুল ইসলাম। একসময় তিনি আর্থিক সংকটে ভুগলেও বর্তমানে অঢেল সম্পদের মালিক। রাজধানীর শ্যামলী নেটওয়ার্ক অপারেশনস অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস অফিসে মিটার রিডার হিসেবে কর্মরত রফিকুল। দুর্নীতির মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

একেএম রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া, মিটার টেম্পারিং এবং বিল কারসাজির অভিযোগ রয়েছে। দ্য বিজনেস পোস্টের অনুসন্ধানে দেখা যায়; অন্যান্য সম্পত্তির পাশাপাশি তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যানে রোড ১-এ ৪ এবং ৭ নম্বর দুটি বহুতল বাড়ির মালিক।

চাঁদ উদ্যানের বাসিন্দা শোয়েব হোসেন যিনি রফিকুলের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর দুর্নীতি ও বিভিন্ন অসাধু উপায়ে ২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করেন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।

অভিযোগে শোয়েব বলেন, চাঁদ উদ্যানের দুটি বাড়ি ছাড়াও রফিকুল অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা দিয়ে নিজ এলাকায় কয়েক একর ফসলি জমি এবং মোহাম্মদপুরের কাটাসুরে ১ নম্বর রোডের হুরজাহান ভিলার দ্বিতীয় তলায় একটি রাস্তামুখী ফ্ল্যাট এবং আরেকটি কিনেছেন লালমাটিয়ায়।

মজার বিষয় হল, রফিকুল নিজেই এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন দুর্নীতির টাকা দিয়ে চাঁদ উদ্যানে দুটি বাড়ি বানানোর কথা। তিনি প্রতিবেদককে তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন না করার অনুরোধ করেন এবং ঘুষের প্রস্তাবও দেন।

প্রতিবেদক সম্প্রতি চাঁদ উদ্যানে গিয়ে দেখেন ওই এলাকায় রফিকুলের মালিকানাধীন দুটি বাড়ির একটি সাদ বিশ্বাস ম্যানশন। এটি চারতলা ভবন। বাড়ির কেয়ারটেকার আইয়ুব আলী জানান; ১০-১২ বছর আগে তিন কাঠা জমি কিনেছিলেন রফিকুল।

তিনি বলেন; “পরে রফিকুল বাড়ি তৈরি করেন এবং ফ্ল্যাট ভাড়া দেন। এ বাড়িতে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে, যা তিনি ডিপিডিসির কর্মচারি হিসেবে নিয়েছিলেন। ২০২২ সালে ডিপিডিসি এজন্য তাকে জরিমানাও করেছিল।”

তিনি আরও বলেন, রফিকুল কখনও এ বাড়িতে থাকেননি। তিনি কাটাসুরের ফ্ল্যাটে থাকেন। ফ্ল্যাটটি লতিফ রিয়েল এস্টেটের তৈরি।

স্থানীয় একজন দোকানদার যিনি সাদ বিশ্বাস ম্যানশনে ভাড়া থাকতেন তিনি জানান; রফিকুল নব্বই দশকের শেষ দিকে ডিপিডিসি সাতমসজিদ অফিসে কাজ করতেন।

তিনি বলেন; “তখন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান, মোহাম্মদী হাউজিং ও নবোদয় হাউজিং সোসাইটির উন্নয়ন কাজ চলছিল। সেসময় রফিকুল অবৈধ বিদ্যুতের লাইন সরবরাহ এবং মিটার ও বিল টেম্পারিংসহ বিভিন্ন অসাধু কাজ করত। তিনি আবাসিক ও বাণিজ্যিক মিটার বিক্রিতেও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।”

ডিপিডিসির একাধিক সূত্র ও চাঁদ উদ্যানের বাসিন্দারা জানান, ডিপিডিসি সাতমসজিদ অফিসে চাকরি করতে গিয়ে রফিকুল অনেক অর্থসম্পদের মালিক বনে যান। ২০০৭ সালে, তিনি ৩০ লাখ টাকায় সাদ বিশ্বাস ম্যানশন কিনেছিলেন। বাড়িটির বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। ২০১৮ সালে, চাঁদ উদ্যানে একই রাস্তায় অপর বাড়িটি কিনেন। এর বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। দুই বাড়ির সামনে খালি আছে প্রায় পাঁচ কাঠার প্লট।

স্থানীয়রা জানান; বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তার মালিকানাধীন প্লট কেনার জন্য সম্প্রতি রফিকুল ৩০ লাখ টাকা অগ্রিম পরিশোধ করেছেন।

সম্প্রতি এই প্রতিবেদক রফিকুলের সাথে তার অফিসে দেখা করলে তিনি প্রথমে বলেন; তার সব সম্পত্তি শ্বশুরের মালিকানাধীন এবং তিনি শুধু সেগুলো দেখাশোনা করছেন। পরে সে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পত্তি অর্জনের কথা স্বীকার করে।

এরপর তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ না করার অনুরোধ জানায় সে। তিনি আরও বলেন, বিষয়টি নিয়ে আগেও অনেক সাংবাদিক তার সঙ্গে কথা বলেছেন কিন্তু তার কিছুই হয়নি। তারপর তিনি এই সংবাদদাতাকে তাকে নিয়ে দুর্নীতির রিপোর্ট করা থেকে বিরত করার জন্য ঘুষের প্রস্তাব দেন।

এরপরও এক ব্যক্তি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এই প্রতিবেদকে ফোন করে বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা বলেন। 

সাদ বিশ্বাস ম্যানশনের এক বাসিন্দা দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, “আপনি জানেন না সে কত বড় অপরাধী (রফিকুল)। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ও সাংবাদিক এলেও কেউ কিছু করতে পারেনি। টাকা দিয়ে সবাইকে ম্যানেজ করে ফেলে।

শোয়েব তার অভিযোগে বলেন, পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বোয়ালমারী গ্রামের ফয়েজ উদ্দিন ও তাহিরুন নেছা দম্পতির ছেলে রফিকুল ডিপিডিসিতে মিটার রিডার হিসেবে যোগদানের আগে আর্থিক সংকটে ছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে তার ভাগ্য খুলতে থাকে। সে বস্তি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের পাশাপাশি আবাসিক গ্রাহকদের বিল কমাতে মিটারে কারচুপি করে প্রতিমাসে অবৈধভাবে অনেক টাকা আয় করছে। শোয়েব আরও বলেন, রফিকুলের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য দুটি মোটরবাইক ও দুটি মাইক্রোবাস রয়েছে। তাছাড়া ১০ লাখ টাকা ধার দিয়ে বন্ধক হিসেবে একটি ফ্ল্যাট পেয়ে বোনকে দেন। তিনি বর্তমানে সেই ফ্ল্যাটটি কেনার চেষ্টা করছেন।