কপালে টিপ পরায় রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় এক শিক্ষিকাকে গালি দেয়ার পর তার পায়ে মোটরসাইকেলের চাকা তুলে হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে এক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার।
এ ঘটনার পর থেকে ফেসবুকে টিপ পরা ছবি দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন নারী-পুরুষ অনেকেই। তারা বলছেন, টিপের উপর এমন আঘাত-বাঙালি সংস্কৃতির উপর আঘাত, নারীর স্বাধীনতার উপর আঘাত।
ইভটিজিং ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগে প্রভাষক লতা সমাদ্দার শনিবার শেরেবাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ জানায়, এ ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
ভুক্তভোগী শিক্ষিকার স্বামী মলয় বালা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের অধ্যাপক।
লতা সমাদ্দারের অভিযোগ, হেঁটে কলেজে যাওয়ার সময় পাশ থেকে মধ্যবয়সী পুলিশের পোশাক পরা মোটরসাইকেলে থাকা এক ব্যক্তি তাকে ‘টিপ পরছোস কেন’ বলে গালি দেয়। প্রতিবাদ জানালে এক পর্যায়ে তার পায়ের ওপর দিয়ে বাইক চালিয়ে চলে যান সেই ব্যক্তি। এতে তিনি আহত হন। গতকাল সকাল ৮টা ২০ মিনিটের সময় ঘটনাটি ঘটে। প্রতিবাদ করায় তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে। ঘটনাটি তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানান এবং থানায় অভিযোগ করেন।
তিনি আরও বলেন, এর আগেও রাস্তাঘাটে বিভিন্ন সময় বাজে কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু পুলিশের পোশাক পরিহিত ব্যক্তি যখন এ ধরনের আচরণ করলেন, তা সহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল না।
এ ব্যাপারে সংসদে সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, ‘দল-মত নির্বিশেষে বিশেষ করে নারী সমাজের জন্য অত্যন্ত ঘৃণিত একটি ঘটনা। ইভটিজিং আমরা শুনে এসেছি। বখাটে ছেলেরা স্কুলের মেয়েদের ইভটিজ করে। সেই পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু আমি যখন দেশের আইনরক্ষাকারী কাউকে ইভটিজিংয়ের ভূমিকায় দেখি, তখন সেটা আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক।’
সংসদে প্রশ্ন তুলে বলেন, বাংলাদেশের কোন সংবিধানে, কোন আইনে লেখা আছে যে একজন নারী টিপ পরতে পারবে না। এখানে হিন্দু-মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এমনকি সে বিবাহিত না বিধবা সেটা বিষয় নয়।
তিনি আরও বলেন, ‘তাকে (শিক্ষিকাকে) অসম্মান করা হয়েছে। আমি সরকারি দলকে রিপ্রেজেন্ট করি, নাকি বিরোধী দলকে রিপ্রেজেন্ট করি- বিষয়টা এগুলোর ঊর্ধ্বে। প্রধানমন্ত্রী সবসময় বলেন, মানুষ আগে। মানুষের অধিকার আগে। জাতির পিতা বলেছেন, মানুষকে ভালোবাসতে হবে। মানুষের অধিকার আগে। যে মন্ত্রণালয় এই বিষয়টি দেখা-শোনা করে তারা যেন দ্রুত পদক্ষেপ নেয়, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে।’
সাবেক এমপি অধ্যাপক অপু উকিল লিখেছেন, ‘টিপের সাথে এই উপমহাদেশের অনেক প্রাচীন সম্পর্ক রয়েছে। আমি কপালে টিপ পরতে খুব ভালোবাসি। শুধু ভালোবাসাই নয়, আমি বিশ্বাস করি, টিপের সঙ্গে আমার সংস্কৃতি এবং আস্থা জড়িয়ে রয়েছে।’
সাংবাদিক ও কলামিস্ট মাসুদা ভাট্টি প্রতিবাদ করে বলেছেন, ‘টিপটা সবুজ, যা বাংলাদেশকে নির্দেশ করে সব সময়। কিন্তু কারা যেন বাংলাদেশকে (টিপকে) মুছে দিতে চায়। কারা এই নিষ্ঠুর সমাজ তৈরি করছে? অনেকেই অনেক কথা বলেছেন, এই যে দেখুন কারা সমাজকে আরও কট্টর, হিংসাশ্রয়ী করে তুলছে। একটা টিপকে মেনে নিতে যাদের কষ্ট হয় তারা নারীর স্বাধীনতাকে মানবে কেন? ওদিকে একদল করছেন, হিজাব-বোরকা-ছবি না তোলার আন্দোলন, ভগিনীগণ আপনারা কি টিপ পরার স্বাধীনতার পক্ষেও দাঁড়াবেন? নাহলে আপনাদের দাবিতে কেন টিপ-ওয়ালারা গলা মেলাবে বলুন?’
সানারাই দেবী সানু ফেসবুকে লিখছেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অধিকার কারো নেই। টিপ পরার দায়ে প্রভাষক লতা সমাদ্দারকে জনৈক পুলিশের ইভটিজিং ও বাইক দ্বারা প্রাণ নাশের চেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। এই অসংযত আচরণের বহিঃপ্রকাশকে বন্ধ না করা হলে ক’দিন পর আর টিপ পরার বিষয়টি আলাদা করে ধর্মীয় ভাবনায় ভাগ হয়ে যাবে।’
শুধুমাত্র নারীরা নয় ভার্চুয়াল প্রতিবাদ জানিয়েছেন পুরুষরাও। ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী নামে একজন লিখেছেন, ‘এদেশ যতদিন না হবে আফগানিস্তান, টিপ হবে বাঙালি নারীর একান্ত-পরিধান।’
হৃদয় রঞ্চন রায় ফেসবুকে লিখেন, ‘রাস্তাঘাটে আমার মা বোনদের টিপ, সিঁদুর ও শাখা পরার কারণে যদি অপদস্ত, অপামান এমনকি ইভটিজিং করা হয় তবে তা আমাদের সাংবিধানিক এবং মানবিক অধিকারের উপর আঘাত হানে। এমন ঘটনার উস্কানীদাতা বা অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবী জানাচ্ছি। তারা যেন কোন অযুহাতে ছাড় না পায়।’
এ ব্যাপারে শেরে বাংলা নগর থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া বলেন, তেজগাঁও কলেজের একজন নারী প্রভাষকের কাছ থেকে একটি অভিযোগ পেয়েছি। কলেজে যাবার পথে সেজান পয়েন্টের পাশে ইভ টিজিংয়ের শিকার হন তিনি। পুলিশের পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন। তবে ওই পুলিশ সদস্যের নাম বা পদবি জানাতে পারেননি ভুক্তভোগী শিক্ষিকা। তবে একটি মোটরসাইকেলের নাম্বার (মোটরবাইক নম্বর ১৩৩৯৭০) দিয়েছেন তিনি। তদন্ত শুরু হয়েছে।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, শিক্ষিকার অভিযোগ পাওয়ার পর গুরুত্ব দিয়ে ঘটনার তদন্ত চলছে। ওই ব্যক্তি পুলিশের কেউ কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কি ঘটেছে তা বিভিন্ন পর্যায়ে যাচাই করা হচ্ছে।