দেশের একটি অন্যতম পুরানো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। যা ১৯৯৬ সালে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে শীর্ষ তিনটি পদ শূন্য রেখে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য (ভিসি), প্রো-ভিসি ও কোষাধ্যক্ষ পদে কোনো পদাধিকারী নেই।
ভিসির পদটি ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১ থেকে শূন্য রয়েছে, প্রো-ভিসির পদটি ২০০৩ সাল থেকে এবং কোষাধ্যক্ষের পদটি ২০০০ সাল থেকে শূন্য।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিক দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, “আমরা সম্ভাব্য ভিসি প্রার্থীদের নামসহ একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এটি বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে শীর্ষ তিনটি পদ শূন্য থাকা সত্ত্বেও আমরা বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হইনি। যাইহোক, আমরা এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কঠোর নির্দেশনা অনুসরণ করে এ পদগুলো পূরণে কাজ করছি।”
কমপক্ষে ২২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পিপলস ইউনিভার্সিটি একটি যার বর্তমানে শীর্ষ তিনটি পদ দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে রয়েছে।
ভিসি, প্রো-ভিসি এবং ট্রেজারার ছাড়া যে ২১টি বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করছে তার মধ্যে রয়েছে গ্রীন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সিটি ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, বাংলাদেশ ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের প্রথম ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি। চুয়াডাঙ্গা, কুমিল্লার ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটি, চিটাগা ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, গাজীপুরে জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, মানিকগঞ্জে এনপিআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, নারায়ণগঞ্জের রূপায়ণ একেএম শামসুজ্জোহা ইউনিভার্সিটি, বরিশালে শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি, ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকায় মাইক্রোল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। কিশোরগঞ্জে শেখ হাসিনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রামে বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি।
এক পলকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ২০১০-এর ২৯ (১) ধারা অনুযায়ী, প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ভিত্তিতে ভিসি, প্রো-ভিসি, কোষাধ্যক্ষ এবং রেজিস্ট্রার নিয়োগ করা বাধ্যতামূলক।
কিন্তু বছরের পর বছর ধরে দেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় পদ শূন্য থাকায় একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
ইউজিসির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১০৯টি অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশের কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেই।
৩৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদ শূন্য রয়েছে এবং সেগুলোর বেশিরভাগই প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব ট্রাস্টি দ্বারা নির্বাচিত ভারপ্রাপ্ত ভিসি দ্বারা পরিচালিত হয়।
উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। অন্তত ৭৯টি প্রতিষ্ঠানে কোনো প্রো-ভিসি নেই এবং ৪৩টিতে কোষাধ্যক্ষ নেই।
মাত্র ১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শীর্ষ তিনটি পদ পূরণ করা হয়েছে।
দ্য বিজনেস পোস্টে’র সাথে আলাপকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, নিয়মিত ভিসি বা প্রশাসন প্রধানের অনুপস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দুর্বল করে দেয়।
“ভিসি আছে এমন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংকটের সম্মুখীন। সুতরাং আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে শীর্ষস্থানীয় তিনজন পদাধিকারী ছাড়া যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি চলছে তাদের অবস্থা কী।”
দীর্ঘদিন মূল পদ শূন্য রাখার পেছনে ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এবং এর কারণ খুঁজে বের করে অবিলম্বে শূন্য পদ পূরণে পদক্ষেপ নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানান।
সমস্যা
বিভিন্ন সূত্র বলেছে, যথেষ্ট যোগ্য ও পেশাদার ব্যক্তি রয়েছেন যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শীর্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে, ট্রাস্টি বোর্ড তাদের প্রতি অনুগত প্রার্থী খুঁজে পায় না।
এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম যথাযথভাবে চালিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব উপেক্ষা করে শুধু অর্থ সাশ্রয়ের জন্য মূল পদগুলো খালি রাখছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এমনকি শীর্ষ তিনটি পদ খালি থাকায় এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন; ভিসি একজন একাডেমিক এবং প্রশাসনিক অভিভাবক যিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব দেন এবং কোষাধ্যক্ষ আর্থিক অভিভাবক হিসাবে কাজ করেন। তাদের অনুপস্থিতি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে অমসৃণ করে তোলে।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. হারুন-উর-রশিদ আসকারী দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, “ভিসি বা প্রো-ভিসির মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনুপস্থিতি যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায়।”
তিনি বলেন, “সার্বক্ষণিক ভিসি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং একাডেমিক ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনায় সমস্যার সম্মুখীন হয়।”
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক হারুন বলেন; “প্রতিষ্ঠাতারা সঠিক ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ব্যবসা-ই এখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতাদের মূল লক্ষ্য।”
নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট অনুসারে; রাষ্ট্রপতির কাছে ভিসি পদের জন্য নাম সুপারিশ করা বাধ্যতামূলক। কারণ তিনি সমস্ত পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। এবং রাষ্ট্রপতি-ই ভিসি পদে সঠিক ব্যক্তি নির্বাচন করেন।
এই আইনে ভারপ্রাপ্ত ভিসি, প্রো-ভিসি এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নয় তবে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন লঙ্ঘন করে এই গুরুত্বপূর্ণ পদে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে কাজ করছে।
তবে ইউজিসি কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যমান ভিসির মেয়াদ শেষ হলেই ভারপ্রাপ্ত ভিসি দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়। নতুন ভিসি নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত একজন শিক্ষক অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য ভারপ্রাপ্ত ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
ইউজিসির একজন কর্মকর্তা বলেন; ভিসি নিয়োগের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে চ্যান্সেলরের অনুমোদন পেতে এক মাসের বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু যেহেতু আইনে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি, তাই কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এর সুবিধা নিচ্ছে এবং ভারপ্রাপ্ত ভিসিদের দীর্ঘ সময়ের জন্য তাদের পদে বহাল রাখছে।
শুধু তা-ই নয় বোর্ড অব ট্রাস্টি অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে ভিসি এবং প্রো-ভিসি নিয়োগ করতে নারাজ বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড অ্যাড-হক ভিত্তিতে মূল পদে জনবল নিয়োগ দিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে, তবে এটি অবৈধ।
ইউজিসি পরিচালক (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) মোঃ ওমর ফারুক দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, সুষ্ঠু পরিচালনা পর্ষদ ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে তারা নিয়মিতভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রধান শূন্য পদগুলো পূরণের নির্দেশ দিচ্ছেন।