রিফাত ইসলাম
প্রযুক্তির উৎকর্ষতা আর ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় শহর থেকে গ্রাম সবজায়গায় ক্রমশই বাড়ছে অনলাইনভিত্তিক পড়ালেখার সুযোগ। করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এর গুরুত্ব বাড়ে কয়েকগুণ।
এ সময়ে শিক্ষার্থীরা ভার্চুয়াল ক্লাসের পাশাপাশি শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন অ্যাপের সহায়তা নিয়েছেন। এতে বিদেশি ডেভেলপারদের তৈরী অ্যাপের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মাঝে সাড়া ফেলেছে দেশীয় ডেভলপারদের তৈরী মোবাইল অ্যাপগুলোও।
কারণ, এসব শিক্ষাবিষয়ক অ্যাপ ভিজ্যুয়াল, গ্রাফিক্স, অ্যানিমেশন এবং কুইজ সমৃদ্ধ। তরুণ শিক্ষার্থীরা অ্যাপ ইনস্টল করে তাদের স্মার্টফোনগুলোকে এখন পরিণত করেছে নানামুখী শিক্ষা ও আত্ম-উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সশরীরে ক্লাস বন্ধ থাকায় এসব অ্যাপের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাকালে শিক্ষাবিষয়ক অ্যাপের চাহিদা বেড়েছে ৫ গুণ।
স্মার্টফোনের সাহায্যে শিক্ষার্থীরা গুগল প্লে বা অ্যাপল অ্যাপস স্টোর থেকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত অ্যাপগুলোর ইনস্টল করতে পারেন। যা তাদের সাধারণ শিক্ষা উপকরণ এবং এমনকি উন্নত স্টিম-ভিত্তিক শিক্ষারও সুযোগ রয়েছে।
এসব অ্যাপের কিছু রয়েছে যেগুলো কোনো প্রকার টাকা ছাড়াই ব্যবহার করা যায়। তবে এমন কিছু রয়েছে যেগুলোর সব ফিচার পেতে হলে টাকা দিয়ে সাবস্ক্রিপশন নিতে হয়।
অনেক ব্যবহারকারী দেশীয় অ্যাপগুলোর মান নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। কারণ, তারা ক্লাসে না গিয়েও অ্যাপের মাধ্যমেই সহজ এবং আনন্দের সঙ্গেই নানা জটিল বিষয় শিখতে পারছেন।
অবশ্য, অধিকাংশ অ্যাপের সাবসক্রিপশন নেয়ার বাধ্যবাধকতা এ শিক্ষা পদ্ধতির জন্য বড় বাধা বলছেন শিক্ষার্থীরা।
এ বিষেয়ে পঞ্চগড়ের আলোয়াখোয়া তফশিলি স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র সাহাদাত হোসেন সাকিব বলেন, আমি আমার ফোনে ভিডিও গেম খেলছি না, পড়াশোনা করছি- এটি আমার বাবা-মাকে বোঝানো কঠিন। যদি আমি সাবস্ক্রিপশনের জন্য টাকা চাই, তখন তারা এ ভার্চুয়াল ক্লাসের জন্য ফি দিতে চান না।
দেশীয় ডেভেলপারদের তৈরি শিক্ষাবিষয়ক কিছু শীর্ষ অ্যাপ যাচাই করে দেখেছে বিজনেস পোস্ট।
ক্লাসরুম
অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যক্রম সম্পর্কিত নানা সমাধান দিচ্ছে মোবাইল অ্যাপ ‘ক্লাসরুম’।
অ্যাপটির মাধ্যমে লাইভ ক্লাস, পরীক্ষা এবং ডিজিটাল লার্নিংয়ের যে কোনও বিষয়ে শিক্ষার্থীরা সহজেই শিক্ষার নানা দিক সম্পর্কে জানতে পারছে। একইসঙ্গে তাদের কোন বিষয়ে আরও অগ্রগতি দরকার সেটিও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানতে পারছেন।
ডিজিটাল শিক্ষক
আরেকটি অ্যাপ-ভিত্তিক ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম হলো ‘ডিজিটাল শিক্ষক’। শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী এ অ্যাপে ছাত্র, শিক্ষক বা উত্তর দাতা হিসেবে নিবন্ধিত হতে পারেন ব্যবহারকারীরা। অ্যাপটিতে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করার সুযোগ রয়েছে। এটি দ্রুতই নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কিত যে কোন সমস্যার সমাধান দিতে পারে।
এসোশিখি
২০১৬ সালে তৈরি মোবাইল অ্যাপটি এসএসসি, এইচএসসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির শিক্ষার্থীদের গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতে কাজ করছে।
প্রতিটি ক্লাসের জন্যই অ্যাপটিতে রয়েছে আলাদা আলাদা বিষয়ভিত্তিক কোর্স। অ্যাপটিতে রয়েছে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ব্যবস্থাও, এতে মূল্যায়িত হয় কতটা উন্নতি কিংবা অবনতি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
অ্যাপটির কিছু কিছু কোর্স রয়েছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যের, তবে কিছু রয়েছে যেগুলো টাকা দিয়ে এক্সেস নিতে হয়। ভর্তি পরীক্ষার পাশাপাশি পরীক্ষার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে ব্যবহারকারীরা সমাধান ম্যানুয়ালের পাশাপাশি মডেল টেস্টেও প্রবেশ করতে পারে।
শিখো
এ অ্যাপটি এসএসসি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি স্ট্রাকচার্ড কোর্স লাইব্রেরি দিয়ে থাকে। একইসঙ্গে এইচএসসি শিক্ষার্থীদের জন্যও রয়েছে বিভিন্ন পাঠ। যা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের দ্বারা ডিজাইন এবং প্রস্তুত করা হয়েছে।
অ্যাপে ব্যবহারকারীরা অন-ডিমান্ড অ্যানিমেটেড ভিডিও পাঠ দেখতে পারেন। বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত লাইভ ক্লাসে অংশ নিতে পারেন, সংক্ষিপ্ত ডিজিটাল নোট খুঁজে পেতে পারেন এবং ইন-অ্যাপ টেস্টিং বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যবহার করে প্রশ্নগুলো অনুশীলন করতে পারেন যা স্বয়ংক্রিয় বিশ্লেষণ এবং ড্যাশবোর্ডেরও অনুমতি দেয়।
শিখো সম্প্রতি ১.৩ মিলিয়ন ডলার প্রাথমিক তহবিল সংগ্রহ করেছে, যা দেশীয় এডটেক স্টার্টআপগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড়।
দ্য বিজনেস পোস্ট-এর সঙ্গে আলাপকালে কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহির চৌধুরী বলেন, উচ্চমানের শিক্ষা সহজ করাই আমাদের লক্ষ্য।
তিনি বলেন, কোর্সগুলো কম ফিতে শিক্ষার্থীদের দিতে আমরা কাজ করছি। প্রথাগত পদ্ধতি তথা বাসা-বাড়ি কিংবা কোচিংয়ে শিখতে যেখানে বর্তমানে প্রতি মাসে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়, সেখনে আমাদের একটি শিখো কোর্সে একই ধরনের খরচ হবে। যা অনেক বেশি ফিচারসহ পুরো বছরই শিখতে পারবেন শিক্ষার্থীরা।
টেন মিনিটস স্কুল
২০১৪ সালে আয়মান সাদিক প্রতিষ্ঠিত টেন মিনিটস স্কুল শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কোর্স ও পাঠ্যক্রম অনুযায়ী নানা বিষয়ের সমাধান দিয়ে থাকে।
এটি উচ্চতর শিক্ষা এবং বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়নেরও দিকনির্দেশনা দেয়। সব বয়সী শিক্ষার্থীদেরই জন্যই অ্যাপপি বেশ কার্যকর।
মুক্তপথ
বাংলাদেশ সরকারের অক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) কর্তৃক তৈরি মুক্তপাঠ সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিভিন্ন বিষয়ে পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা বৃদ্ধি সুযোগ দেয়। এবং এটিতে আজীবন শেখার সুযোগ রয়েছে।
অ্যাপটি একটি কোর্স শেষ করার পর সার্টিফিকেটসহ বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ দেয়।
প্রত্যয় ভিজ্যুয়াল লার্নিং অ্যাপ
এ অ্যাপটি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ভার্চুয়াল প্রাইভেট শিক্ষকের সেবা দিয়ে থাকে। যা নির্মিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, কুয়েট এবং ডিএমসিএইচ শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে।
সাবসক্রিপশন ফিসহ এর প্রিমিয়াম সংস্করণটি এইচএসসির বিজ্ঞান বিভাগের জন্য এনসিটিবি সিলেবাসের ভিজ্যুয়াল ক্লাস অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
অ্যাপের মূল বৈশিষ্টের মধ্যে রয়েছে ৫ হাজারেরও বেশি ভিএফএক্স ভিডিও, একটি বড় অনলাইন প্রশ্ন ব্যাংক, সমাধানসহ গত পাঁচ বছরের এইচএসসি প্রশ্ন, ২৫ হাজার অনুশীলন প্রশ্ন ও উত্তর, ৬০০ ঘন্টারও বেশি প্রিমিয়াম ভিডিও, ২৫ টিরও বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ও সমাধান।
এডমিশন অসিসট্যান্ট
এ অ্যাপটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি সহজ করে। প্ল্যাটফর্মটি শিক্ষার্থীদের অধ্যয়ন উপকরণ, মডেল টেস্ট, ভর্তি বিজ্ঞপ্তি এবং অন্যান্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে।
মোবাইল শিক্ষামূলক অ্যাপের প্রভাব
দ্য বিজনেস পোস্ট-এর সঙ্গে আলাপকালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, এ অ্যাপগুলোর মধ্যে কয়েকটি রয়েছে, যেগুলো গ্রামীণ ও শহুরে এলাকার মানসম্মত শিক্ষার ব্যবধান দূর করতে বেশ কার্যকর।
অবশ্য, তারা যে সাবসক্রিপশন ফি নেয় তা প্রন্তিক শিক্ষার্থীদের সাধ্যের বাইরে। শিক্ষাভিত্তিক উদ্যোগের একমাত্র উদ্দেশ্য ব্যবসা হওয়া উচিত নয় বলেও মনে করেন তিনি।
অ্যাপগুলো তৈরি ভাল উদ্যোগ হলেও বেশিরভাগের বিষয়বস্তুই অনিয়ন্ত্রিত এবং যাচাই করা হয়নি বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এ শিক্ষাবিদ।
অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, এসব উদ্যোগকে একটি জাতীয় শিক্ষাক্রম কমিশনের অধীনে বা শিক্ষাবিদদের একটি সংগঠনের অধীনে আনা উচিত। যাতে, উদ্যোক্তাদের পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ দেয়া যায়।