ওষুধের দাম গত ছয় মাসের ব্যবধানে ১৩ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে প্যারাসিটামল সিরাপের দাম। এছাড়া গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ, এন্টিবায়োটিক, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধের দাম বেড়েছে ১৩ থেকে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত।
বুধবার ‘ঔষধের অযৌক্তিক ও অনৈতিকভাবে মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ' শীর্ষক এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরে কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাব বলে, দেশে যখন প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী তখন ওষুধের মতো এতো প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সরকার ওষুধের মার্ক-আপ কমিয়ে ওষুুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত বলে আমরা মনে করছি।’
ক্যাব সংবাদ সম্মেলনে ওষুধ ও কাঁচামাল আমদানিতে মার্ক-আপ কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা ও স্যালাইন তৈরি-বাজারজাতকরণ সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করাসহ ৪ দফা সুপারিশ করে।
ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়ন হলেও অনেক অব্যবস্থাপনা রয়েছে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের দেশে ঔষধ তৈরির প্রক্রিয়া ন্যয় সঙ্গত কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। কোম্পানিগুলোর কাছে কোনরকম একাউন্টিবিলিটি ছাড়াই দাম বৃদ্ধির বিষয়টি ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এতে ঔষধ প্রশাসনের কাছে থাকা ১১৭ টি ঔষধ ছাড়া বাকিগুলো কোম্পানি তাদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে। সম্প্রতি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর আপত্তি সত্ত্বেও সম্প্রতি ঔষধের দাম পুনরায় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া শুধু অন্যায়ই নয় বেআইনিও।’
ঔষধের দাম বৃদ্ধিও চিত্র তুলে ধরে ক্যাব বলেছে, দেশের ওষুধ শিল্প সম্প্রসারণ করলেও সামাজ্যবাদের আগ্রাসন থেমে নেই। শুরুতে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করলেও এখনও তাদের ভূমিকা অদৃশ্যভাবে বহাল রয়েছে। ১৯৯৪ সালের তৎকালীন সরকার ওষুধ শিল্পের ওপর কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণ চালু করে। এক আদেশে দেশের উৎপাদিত ওষুধের মধ্যে মাত্র ১১৭টি জেনেরিক ওষুধ সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকি ওষুধ কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে দেয়।
যদিও দেশে ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে ওষুধ আইন ১৯৪০, ১৯৪৫ সালের ড্রাগ রুলস, ১৯৪৬ সালের দ্য বেঙ্গল ড্রাগস রুলস, ১৯৮২ সালের ড্রাগ অর্ডিন্যান্স এবং ২০১৬ সালে জাতীয় ওষুধ নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এরপরও ১৯৯৪ সালের সেই আদেশ প্রত্যাহার হয়নি।ওই আদেশের বলে পুরো ওষুধ শিল্পের নিয়ন্ত্রণ মূলত কোম্পানিগুলোর হাতে চলে যায়।
দেশে ওষুধ শিল্প বিস্তার লাভ করলেও ওষুধ তৈরির কাঁচামাল এখনও বিদেশ-নির্ভর। শতকরা ৯৭ ভাগ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এদের মধ্যে অধিকাংশই মূলত ভারত ও চীন থেকে আসে। কিছু কাঁচামাল আসছে উন্নত বিশ্বের কয়েকটি দেশ থেকে। তবে নিম্ন আয়ের দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশ ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক সুবিধা পেয়ে আসছে যা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বহাল রয়েছে। তবে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ মধ্য-আয়ের দেশে পরিণত হলে এই সুবিধা বহাল থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
সরেজমিনে ফার্মেসিতে খুচরা ওষুধের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ গত জুলাই মাস হতে বেড়েছে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ। ২০ মিলিগ্রামের একটি অমিপ্রাজল ওষুধের দাম ছিল ৫ টাকা তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬ টাকা। ২০ মিলি গ্রামের রেবিপ্রাজলের দাম ছিল ৫ টাকা তা বাড়িয়ে ৭ টাকা করা হয়েছে।
এন্টিবায়োটিক ট্যাবলেট এর দাম বেড়েছে ১৭ থেকে ২০ শতাংশ। প্রতিটি ৫০০ মিলিগ্রামের সিডিউরিক জিম ট্যাবলেট এর দাম ছিল ৫০ টাকা তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬০ টাকা। ২৫০ মিলি গ্রামের প্রতিটি ট্যাবলেটের দাম ছিল ৩০ টাকা তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৫ টাকা। প্রেসার ও হার্টের ওষুধের দাম বেড়েছে ১৩ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত।
ক্যাবের সুপারিশে বলা হয়, আইভিফ্লুয়িড জাতীয় ওষুধের দাম বৃদ্ধি প্রক্রিয়াধীন, এমন একতরফাভাবে যখন তখন, যত খুশি তত বেশি মূল্যবৃদ্ধি করা ভোক্তা অধিকার ও স্বার্থের পরিপন্থী। সুতরাং ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে অনতিবিলম্বে বৃদ্ধি করা ওষধের মূল্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগণের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত কমিটি দ্বারা রিভিউ করার দাবি জানানো হয়।
উক্ত রিভিউ না হওয়া পর্যন্ত আইভি ফ্লুইড জাতীয় ওষুধসহ অন্যান্য ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়া স্থগিত করারও দাবি করা হলো। ১৯৯৪ সালের কালো আদেশটি বাতিল করতে হবে। ওই আদেশের কারণে কোম্পানিগুলো যখন তখন ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। ওষুধের কাঁচামাল এবং অন্যান্য ওষুধ আমদানিতে মার্ক-আপ কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
আমদানিকৃত ওষুধে মার্ক-আপ ও কমাতে হবে। সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে ওষুধের দামবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। স্যালাইন তৈরি ও বাজারজাতকরণ সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট বা আইপিএইচ এর মাধ্যমে করতে হবে।