প্রচ্ছদ ›› স্বাস্থ্য

ভুল চিকিৎসায় গেলো প্রাণ, অনিশ্চয়তার পথে পরিবার

কামরুল হাসান
৩১ মে ২০২৩ ১৪:২১:৫১ | আপডেট: ৯ মাস আগে
ভুল চিকিৎসায় গেলো প্রাণ, অনিশ্চয়তার পথে পরিবার
জাকির হোসেন খান

একটি ট্যুর অপারেটিং ব্যবসা পরিচালনা করেন জাকির হোসেন খান। গত ১২-ই মার্চ বুকে ব্যথার কারণে অস্বস্তি বোধ করায় বাড়ির কাছের একটি হাসপাতালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে এই যাওয়া তার জন্য কতটা কষ্টকর ও মর্মান্তিক হতে যাচ্ছে।

৫১ বছর বয়সী জাকির হোসেন এবং তার পরিবার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের উপর আস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু তারা জানতেন না যে, হাসপাতালে রোগ নির্ণয়ে ত্রুটি, ভুল চিকিৎসা এবং অসদাচরণ মাত্র ৪ দিনের মধ্যে জাকির হোসেনকে মৃত্যুর পথে নিয়ে যাবে।

‘দ্য বিজনেস পোস্টে’র সাথে আলাপকালে তার স্ত্রী নুরুন নাহার জানান, জাকির গত ১২ মার্চ সকালে রাজধানীর গ্রিন রোডে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে যান। তার সমস্যার কথা শোনেন গ্রিন লাইফ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ রাশেদুল হাসান কনক। পরে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে তিনি জানান, জাকির গ্যাস্ট্রাইটিসে ভুগছেন। রিপোর্ট দেখা শেষে ওই দিন বিকেলেই তাকে ছেড়ে দেন।

কিন্তু সময় যত যেতে থাকে জাকিরের শারীরিক অবস্থার ততোই অবনতি হতে থাকে। সেজন্য তাকে ওই দিন সন্ধ্যায়-ই পান্থপথের বিআরবি হাসপাতালে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পরিবার। বিআরবি’র গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি এবং হেপাটোলজি বিশেষজ্ঞ ডাঃ মাহবুবুল আলম প্রিন্সের কাছে দেখানো হয় তাকে। তিনি গ্রিন লাইফে করা জাকির হোসেনের ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি) রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে একজন কার্ডিওলজিস্টের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

পরে জাকির হোসেন এবং তার স্ত্রী নাহার ওই হাসপাতালের ক্লিনিকাল এবং ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ শেখর কুমার মন্ডলের কাছে গেলে তিনি অবিলম্বে আরেকটি নতুন ইসিজি পরীক্ষা করতে বলেন। প্রথম ইসিজি করার ১২ ঘণ্টা পরে আবারও ডাঃ শেখর ইসিজি এবং একটি ইকোকার্ডিওগ্রাম (ইসিএইচও) করেন। এ সময় নাহার তাকে জানান যে জাকির হোসেনের একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। যার ফলে তার হার্ট দুর্বল।

এরপরও আশানুরূপ চিকিৎসা না পাওয়ায় জাকির হোসেনের আরও ভালো চিকিৎসার জন্য গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তারা। কিন্তু ডাঃ শেখর তাকে নিরুৎসাহিত করে বলেন, সেখানে চিকিৎসা পেতে দীর্ঘ সময় লাগবে। তাই ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

ল্যাবএইড হাসপাতালে যাওয়ার পর সেখানকার ক্লিনিকাল এবং ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক ডাঃ এমজি আজমের সাথে কথা বলার পর তারা জানতে পারেন রাতে হাসপাতালের ক্যাথেটারাইজেশন ল্যাবরেটরির কার্যক্রম বন্ধ থােকে। পরে ডাঃ শেখরের পরামর্শমত জাকির এবং নাহার আবারও দ্রুত গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ফিরে যান।

সেখানে ডাঃ শেখর এবং ডাঃ আজম তাড়াহুড়ো করে জাকিরের স্টেন্ট ইনস্টলেশন অপারেশন করেন। কিন্তু এর জন্য রোগীর পরিবারের কাছ থেকে কোন সম্মতি নেন না তারা। এর কিচুক্ষণ পরে ডাঃ আজম অপারেশন সফল হয়েছে বলে দাবি করলেও জাকিরের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। এরপর তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এর তিন দিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

অভিযোগ

জাকির হোসেনের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা ডাঃ রাশেদুল, ডাঃ শেখর ও ডাঃ আজমের বিরুদ্ধে রোগ নির্ণয়ে ত্রুটি, ভুল চিকিৎসা ও অসদাচরণের অভিযোগ করেছেন।

ডাঃ শেখর এবং ডাঃ আজম জাকিরের উপর যে পার্কিউটেনিয়াস করোনারি ইন্টারভেনশন (পিসিআই) অপারেশন করেছিলেন সেটা তার মৃত্যুর পর। তার পরিবার বেশ কয়েকজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জানতে পারেন যে অসুস্থতা শুরু হওয়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে এ ধরনের অপারেশন করা হয়। কিন্তু তারা প্রায় ১৩ ঘণ্টা পরে জাকিরের এ অপারেশন করে।

জাকির হোসেনের স্ত্রী নুর নাহার বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা এই হাসপাতালে অপারেশন করাতে চাইনি। কিন্তু তারা আমাদের সিদ্ধান্ত ছাড়াই তাড়াহুড়ো করে অপারেশন করেছে। অপারেশন সফল হয়েছে বলেও দাবি করেন ডাঃ আজম।’

কিন্তু পরে জাকিরের প্যাথলজি রিপোর্ট দেখে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আমাদের বলেছিলেন যে, সেই মুহুর্তে জরুরি পিসিআই অপারেশন বাধ্যতামূলক ছিল না। উভয় ডাক্তারই জাকিরের সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় না করে চিকিৎসা দিয়েছে। তারা ডায়াবেটিকের মাত্রা উপেক্ষা করে রোগীর জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। যা ক্রমান্বয়ে রোগীর মৃত্যুর কারণ বলেও অভিযোগ করেন তারা।

কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ শেখর এ বিষয়ে বলেন, অপারেশনের আগে জাকিরের রক্তে শর্করার মাত্রা ছিল ১৭। অপারেশনের পর তিনি যখন সিসিইউতে ছিলেন তখন তা ২৬-এ গিয়ে দাঁড়ায়।

কিন্তু এ সময় চিকিৎসক তাকে কোনো ইনসুলিন দেয়া হয়নি। যার ফলে জাকিরের শরীরে কিটোন বডির বিকাশ ঘটে।

এদিকে, গ্রীন লাইফ হাসপাতালের প্রদত্ত চিকিৎসা পদ্ধতির নথিতে ডাঃ আজমের কোনো স্বাক্ষর দেখা যায়নি। যদিও অপারেশন করা ডাক্তারদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। নথিতে ডাঃ আজমকে শুধুমাত্র একজন পরামর্শক হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিষয়টি নাহার ও তার পরিবারের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি।

অনুসন্ধান চলছে

জাকিরের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী নুরুন নাহার গত ১৮ এপ্রিল স্বাস্থ্য পরিষেবা অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস) এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) ডাঃ রাশেদুল, ডাঃ শেখর এবং ডাঃ আজমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। এরই প্রেক্ষিতে গত ৩০ এপ্রিল ডিজিএইচএস চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। একই সময়ে বিএমডিসিও বিষয়টি খতিয়ে দেখা শুরু করে।

যেহেতু বিষয়টি তদন্তাধীন, তাই বেশ কিছু কার্ডিওলজিস্ট এবং ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট বিশেষজ্ঞরা দ্য বিজনেস পোস্টের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে তারা জানান যে যথাসময়ের (নির্ণয়ের ১২ ঘন্টা) পরে জরুরী পিসিআই করা, রোগীর পরিবারের সম্মতি না নেয়া, একটি নির্দিষ্ট হাসপাতালে যেতে বলা, প্যাথলজিকাল রিপোর্টকে উপেক্ষা করা এবং কিটোন বডির বিকাশসহ বিভিন্ন সন্দেহজনক বিষয় এতে রয়েছে ।

এছাড় কনট্রাস্ট হিসাবে এলএডি-এর সাথে স্টেন্টিং করার সময় পিসিআই-এ ব্যবহৃত বৈসাদৃশ্য (ডাই) এর ধরণ এবং পরিমাণ একটি কারণ হতে পারে; যা কিডনির ক্ষতি এবং নষ্ট করে দিতে পারে বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা।

আমেরিকান বোর্ড অফ প্রফেশনাল লাইবিলিটি অ্যাটর্নিদের মতে, যখন কোনও হাসপাতাল, ডাক্তার বা স্বাস্থ্য সেবায় নিয়েজিতদের অপেশাদার আচরণ কোন রোগীর জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাড়ায় তখনই বিপদ ঘটে। এ সময় তিনি চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু অসৎ আচরণের উদাহরণ টানেন। সেগুলো হলো- রোগের লক্ষণগুলো শনাক্তে ব্যর্থতা, নির্ণয়ে ব্যর্থতা, পরীক্ষাগারের ফলাফলগুলোর ভুল পর্যবেক্ষণ, সঠিক পরীক্ষার পরামর্শ দিতে ব্যর্থ হওয়া, রোগীর রোগের অতীত ইতিহাস/রিপোর্টকে উপেক্ষা করা, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার, অস্ত্রোপচারে ত্রুটি বা ভুল সার্জারি এবং দুর্বল ফলোআপ বা যত্ন না নেয়া ইত্যাদি।

স্বাস্থ্য পরিষেবা অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ডাঃ মোহাম্মদ শায়েখ আবদুল্লাহ ‘দ্য বিজনেস পোস্ট’কে জানান তারা ইতোমধ্যে অভিযোগকারী এবং বিবাদীদের সাথে কথা বলেছেন। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতিটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে যাচাই করা হচ্ছে, যাতে কোনও কিছু বাদ না পড়ে। সেই সাথে আমরা আশা করছি জুনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে ডাঃ আজম এবং ডাঃ শেখরের সাথে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের সাড়া মেলেনি। তবে গ্রীন লাইফ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ মইনুল আহসান বলেন, ‘বিএমডিসির পাঁচ সদস্যের একটি দল ইতোমধ্যে হাসপাতাল পরিদর্শন করেছে এবং ডিজিএইচএসও তদন্ত করছে। তাদের তদন্তের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর হাসপাতাল বিবৃতি দেবে।’

সূত্র জানায়, বিএমডিসি’র পক্ষ থেকে গত ২১ মে ওই তিন চিকিৎসককে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে চিঠি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তাদের বক্তব্য জমা দিতে বলা হয়েছে। এরপর দলটি অভিযোগকারীদের সঙ্গে কথা বলবেন।

এদিকে ডিজিএইচএস’র উপ-পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক ইউনিট) ডাঃ আবু হুসেন মোঃ মইনুল আহসান বলেন, গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রতিবেদন জমা হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে শুধু চিকিৎসক নয়, জড়িত থাকলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি জাকির হোসেন। এক ও ১২ বছর বসয়ী দু’টি মেয়ে রয়েছে তার। স্ত্রী নুরুন নাহার, বাবা-মা এবং প্রয়াত বড় ভাই মইনুল হোসেনের তিন সন্তান নিয়ে সংসার চালাতেন জাকির।

জাকিরের স্ত্রী নাহার বলেন, ‘জাকির কোনো জমানো সম্পদ বা অর্থ রেখে যাননি। আমরা কি করব জানি না। ইতোমধ্যে শুনেছি- ডাঃ আজমের বড় রাজনৈতিক ক্ষমতা রয়েছে। বিষয়টি তদন্তের ফলাফলকেও প্রভাবিত করতে পারে। সঠিক বিচার না পেলে প্রয়োজনে আমরা আদালতে যাব।’