প্রচ্ছদ ›› স্বাস্থ্য

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খোসপাঁচড়া ঠেকাতে জরুরি ব্যবস্থার আহ্বান এমএসএফ’র

টিবিপি ডেস্ক
১২ জুলাই ২০২৩ ১৬:৫৪:৪০ | আপডেট: ৯ মাস আগে
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খোসপাঁচড়া ঠেকাতে জরুরি ব্যবস্থার আহ্বান এমএসএফ’র

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খোসপাঁচড়া’র প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ)।

এমএসএফ এর মতে, এর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আনতে দ্রুত ও বিস্তৃত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ক্যাম্পে বিদ্যমান পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধির উন্নয়নেও ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, জনবহুল এ শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে আনুমানিক ৪০ শতাংশ মানুষ বর্তমানে স্ক্যাবিসে আক্রান্ত। কিছু কিছু ক্যাম্পে এ আক্রান্তের হার ৭০ শতাংশেরও বেশি।

চিকিৎসকরা বলছেন, স্ক্যাবিসের চিকিৎসা প্রক্রিয়াটি সহজ। তবে সময়মত চিকিৎসাসেবা না পেলে এটি মানুষের মাঝে গুরুতর শারীরিক ও মানসিক প্রভাব ফেলতে পারে। সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে রোগীদের ত্বক, জামাকাপড় এবং ঘরে কিছু ঔষধ প্রয়োগ করা যা স্ক্যাবিসের পরজীবিগুলোকে নির্মূল করতে পারে। এ পরজীবিগুলোই সংক্রমণের মূল কারণ। তবে এমএসএফ সতর্ক করছে যে, এ রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে শুধু ওষুধই যথেষ্ট হবে না বরং প্রয়োজন প্রাদুর্ভাবের উৎস নির্মূল করা।

বাংলাদেশে এমএসএফ এর মিশন প্রধান কার্স্টেন নোকো বলেন, “বর্তমান প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় ক্যাম্পে ওষুধ বিতরণ বিষয়ে বারবার আলোচনা করা হয়েছে। তবে এ রোগের প্রাদুর্ভাবের যে মূল কারণ; জনবহুল ক্যাম্পের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সেটি মোকাবেলার ব্যবস্থা না নিলে শুধু ওষুধ পুনরায় এ রোগের সংক্রমণ রোধ করতে পারবে না।”

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এমএসএফ টিম ত্বকের নানা রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছে। মার্চ ২০২২ এ যখন থেকে ক্যাম্পে স্ক্যাবিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে, তখন থেকেই এমএসএফ অধিক সংখ্যক রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া শুরু করেছে।

এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ক্যাম্পে এমএসএফ টিম প্রায় ৭০ হাজার রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে যা ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

বাংলাদেশে এমএসএফ এর ডেপুটি মেডিকেল কো-অর্ডিনেটর ডা. পঙ্কজ পাল জানান, “চিকিৎসা দিতে গিয়ে কোনো কোনো দিন আমরা দিনে প্রায় ৭০০ রোগী দেখেছি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পরিস্থিতি এমনই ছিল এবং এই ক্রমবর্ধমান রোগী সামাল দেয়ার পাশাপাশি আমরা আমরা বারবার সতর্ক করেছি সবাইকে। এই রোগী সামাল দিতে গিয়ে ২০২৩ এর ফেব্রুয়ারি থেকে রোগীদের নিজ নিজ ক্যাম্পের কাছাকাছি থাকা স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলো থেকে চিকিৎসা নিতে বলার সিদ্ধান্ত নেই আমরা। এই মুহূর্তে স্ক্যাবিসের জন্য চিকিৎসা নিতে আসা সব রোগীকে আমরা স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারছি না। আমাদের সে সক্ষমতা নেই।”

ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা আজমত উল্লাহ বলেন, “গত বছরের ডিসেম্বর থেকে আমার চার বছরের ছেলের স্ক্যাবিস হয়েছে। প্রথমে তার হাতে এবং পরে পুরো শরীরে ফুসকুড়ি দেখা যায়। আমরা ডাক্তার এবং ফার্মেসির পেছনে অনেক টাকা ব্যয় করেছি। অবশেষে আমার ছেলে সুস্থ হয়, তবে সে পুনরায় খুব দ্রুত আবারো স্ক্যাবিসে সংক্রমিত হয়। সে খুব একটা ঘুমাতে পারে না রাতে, পুরো শরীর চুলকায় এবং ব্যথায় অনেক কাঁদে। আমার বাকি দুই ছেলেরও স্ক্যাবিস এবং আমার ও আমার স্ত্রীর মধ্যেও এই লক্ষণ দেখা দিয়েছে।”

বাংলাদেশে মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স গত বছর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের পানি ও স্যানিটেশন পরিস্থিতি নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে; যা থেকে দেখা যায় যে, ক্যাম্পের পানি ও স্যানিটেশন পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। সেখানে যথাযথ স্যানিটেশনের অভাব এবং পর্যাপ্ত পানির স্বল্পতা রয়েছে। যদিও গত দুই বছরে যথেষ্ট পরিমাণ পানি ও স্যানিটেশন কাঠামোর উন্নয়ন দেখা গেছে (পানির নেটওয়ার্ক প্রতিস্থাপন, ক্লোরিনেশন), তবে এগুলো ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। আগের তুলনায় ব্যবহারযোগ্য শৌচাগার কমেছে। কিছু কিছু এলাকায় প্রতিদিন মাত্র দুই ঘণ্টা পানি পাওয়া যায়। ভূ-গর্ভস্থ পানি হ্রাস পাচ্ছে। গত মাসে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাবানের রেশন প্রতি মাসে দুইটি থেকে কমিয়ে একটি করা হয়েছে।

জামতলী ক্যাম্পে বসবাসকারী ১৮ বছর বয়সী শরণার্থী তাহের বলেন, ‘আমাদের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। আমি স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি কিন্তু এটা মেনে চলা বেশ কঠিন। আমাদের একই বিছানা, জামাকাপড় এবং দৈনন্দিন ব্যবহার্য সবকিছু অন্যের সাথে ভাগ করে ব্যবহার করতে হয়। এখন আমরা স্ক্যাবিস হলেও তাই করছি।’

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খোসপাঁচড়ার প্রাদুর্ভাব এমন একটি সময়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, যখন তাদের জন্য বরাদ্দ কমে যাচ্ছে। হ্রাস পাচ্ছে খাদ্য রেশনিংয়ের পরিমাণ। তহবিল কমে যাওয়ার আগেও ক্যাম্পের মধ্যে সহায়তা সংস্থাগুলো যে পরিষেবা দিতো তার মাত্রা শরণার্থীদের চাহিদা পূরণ করতে পারতো না। এমএসএফের জন্য বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো যে ক্যাম্পগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মী এবং ওষুধ সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও মানুষ বিনা বাধায় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারছে না।

নোকো আরো বলেন, ‘খোসপাঁচড়ার ৪০ শতাংশ হার একটি সতর্কবার্তা। যা আমাদের বার্তা দেয় যে, ক্যাম্পের স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ঠিক নেই এবং এটি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য আরও হুমকিস্বরুপ।’

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরু হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলো এখন ৯ লাখেরও বেশি শরণার্থীর আবাসস্থল, যা এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর মধ্যে একটি করে তুলেছে। এমএসএফ ২০০৯ সাল থেকে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে এবং বর্তমানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং অপুষ্টির চিকিৎসা সহ বেশ কয়েকটি প্রকল্প চালাচ্ছে।