প্রচ্ছদ ›› স্বাস্থ্য

হাসপাতালে পানির হাহাকার, সুপেয় পানি খেতে হয় কিনে

আফরিন আপ্পি
০১ মে ২০২৩ ১৫:০৮:১৮ | আপডেট: ১ year আগে
হাসপাতালে পানির হাহাকার, সুপেয় পানি খেতে হয় কিনে

পানিতে লবণাক্ততা ও আর্সেনিকের কারণে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয়। মাইলের পর মাইল হেঁটে এ অঞ্চলের নারী-শিশুরা সংগ্রহ করেন মিঠা পানি। এমনকি হাসপাতালগুলোতেও নেই সুপেয় পানির কোনও ব্যবস্থা। এতে অন্তহীন ভোগান্তি পোহাতে হয় চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনদের।

সরেজমিনে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার ৫০ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা যায় হাসপাতাল চত্বরে একটি পুকুর ও নলকূপ থাকলেও সেখানকার পানি পানের অযোগ্য।

লবণাক্ত ও আয়রণযুক্ত পানিতেই চলছে অস্ত্রপচারসহ সব কাজ। মাত্রাতিরিক্ত লবণে নষ্ট পানি বিশুদ্ধকারী যন্ত্র। উদ্যোগ নেই ঠিক করার। নেই আলাদা পরিকল্পনা ও বরাদ্দ।

হাসপাতালের এক কর্নারে চোখে পড়ে ওয়াটার এটিএম। ওয়াটার এটিএমটি স্থাপন করেছে স্থানীয় ‘কমিউনিটি সাপোর্ট কমিটি’। সহযোগিতায় ছিল বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারএইড।

বোতল হাতে পানি সংগ্রহের লম্বা লাইন দেখা যায় বুথের সামনে। জানা গেছে, তারা সবাই হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের স্বজন। হাসপাতালের রোগীরা এই বুথ থেকেই কয়েন দিয়ে সংগ্রহ করেন খাবার পানি। সেখানে বিনামূল্যে পানির ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও  টাকা দিয়ে কিনে খেতে হয় সুপেয় পানি।

হাসপাতাল ভবনের ছাদ থেকে বৃষ্টির মৌসুমে পানি সংগ্রহ করে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ফিল্টারিং করে তা নির্দিষ্ট ট্যাংকে রাখা হয়। এরপর সেই ট্যাংক থেকে যায় ওয়াটার এটিএমে, সেখান থেকেই সবাই পানি সংগ্রহ করেন।

এটিএম বুথটিতে ২ টাকার কয়েনে দুই লিটার আর ৫ টাকার কয়েনে মেলে ৫ লিটার পানি। এটি খোলা থাকে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বাকি সময় বেশি দামে বোতলজাত পানিতেই মেটাতে হয় তৃষ্ণা।

ছেলের টাইফয়েড হওয়ায় এক সপ্তাহ যাবত হাসপাতালে থাকছেন রফিকুল আলম। খাবার পানি না থাকায় অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন; “হাসপাতালে ওই একটি বুথ ছাড়া খাবার পানির আর কোনও ব্যবস্থা নেই। ৭ দিন হলো ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে আছি, ওয়াটার এটিএম এখানের একমাত্র ভরসা হওয়ায় সেখানে পানি সংগ্রহের জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। জরুরী প্রয়োজনে দূরের বাজার  থেকে পানি কিনে আনি।”

জোছনা বেগম নামে আরেক রোগীর স্বজন বলেন, “অসুস্থ মানুষের অনেক পানি লাগে। আমার নাতির ডায়রিয়া হয়েছে। তাকে এখানে ভর্তি করেছি। ডাক্তার প্রতিদিন বেশি বেশি পানি খেতে বলেছে। হাসপাতালে পানির ব্যবস্থা না থাকায় টাকা দিয়ে পানি কিনে খাওয়াই।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অঞ্চলের মানুষ নিরুপায় হয়ে পান করছেন লবণ ও আর্সেনিকযুক্ত পানি। ফলে আক্রান্ত হচ্ছেন নানাবিধ রোগে। বিশেষ করে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে পড়ছে হুমকির মুখে।  

এ বিষয়ে পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নীতিশ গোলকার বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, “পুরো পাইকগাছা জুড়েই নিরাপদ পানির সংকট। শ্যালো টিউবওয়েলের পানিতে অনেক বেশি আয়রন থাকে যা পানের অযোগ্য। আর ডিপটিউবওয়েলে পানি ওঠে না। আর্সেনিকযুক্ত লবণাক্ত পানির কারণে এখানে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে লবণাক্ত পানির কারণে এ অঞ্চলের মেয়েদের গর্ভকালীন সময়ে রক্তশূণ্যতা দেখা দিচ্ছে। লবণ পানির কারণে প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন নারীরা। হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।”

“লবণ পানির কারণে স্যানিটেশন ব্যবস্থা কাজ করে না। ঘন ঘন টয়লেটের ফ্ল্যাস নষ্ট হয়ে যায়। অকার্যকর হয়ে পড়ে টয়লেটগুলো। দাকোপ, পাইকগাছা, কয়রা, আশাশুনি, শ্যামনগর এ সব দিকের সমস্যা প্রায় একই রকম।”

তিনি জানান, বেশ কয়েক বছর আগে পৌরসভা থেকে সুপেয় পানি আনা হলেও সেই পানির বিল সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে পাঠালে সেখান থেকে বিল পাস হয়ে আসেনি। ফলে তৈরি হয় সংকট।  

প্রতিদিন ১০টি ইউনিয়নের দেড় শতাধিক রোগী এখানে সেবা নেন। ডিপ টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। ফলে রোগীকে টাকা দিয়েই পানি কিনে খেতে হয়। রক্ষণাবেক্ষণের কাজে এ টাকা ব্যয় হয়। খরচ কমাতে পানি কম খাওয়ায় নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন  নারী ও শিশুরা।

এ বিষয়ে পাইকগাছা পৌর মেয়র সেলিম জাহাঙ্গীর বলেন, “জলবায়ুগত কারণে পাইকগাছায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট । পানির অপর নাম জীবন হলেও পানি নিয়েই প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে এ অঞ্চলের মানুষ। এখানে টিউবওয়েল, পুকুর সব জায়গার পানি পানের অযোগ্য। বাসস্থান থেকে অনেক দূরে মিঠা পানির উৎস। হাসপাতালে আসা রোগী ও রোগীর স্বজনরা সুপেয় পানির অভাবে কষ্ট করে।”

এদিকে উপকূলীয় এলাকার হাসপাতালগুলোতে সুপেয় পানি নিশ্চিতের কাজটি কার এ নিয়েও রয়েছে অস্পষ্টতা। কেউ বলছেন স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানের সব দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের। অপরদিকে স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, এটি স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন। কেউবা বলছেন স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজ। আর স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে হাসপাতালে নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য তাদের আলাদা কোনও ব্যবস্থা নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ক্লিনিক ও হাসপাতাল) ডা. শেখ দাউদ আদনান বলেন, “হাসপাতালের পানি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ স্থানীয় সরকার বিভাগের। ওয়াসার মাধ্যমে অথবা পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে এই কাজগুলো হয়ে থাকে। উপকূলীয় এলাকায়ও পানির চাহিদা স্থানীয় সরকারই পূরণ করে। সুপেয় পানি নিশ্চিতে স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কার্যক্রম নেই। কাজটি স্থানীয় সরকারের দায়িত্বে পড়ে।”

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের খুলনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বাহার উদ্দিন বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, “উপকূলীয় অঞ্চলে পানি সরবরাহ প্রকল্প’ নামে নতুন একটি প্রকল্প এসেছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সুপেয় পানির সমস্যার সমাধান করা যাবে। এ প্রকল্পটি সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ও খুলনা জেলায় সুপেয় পানির সংকট সমাধানে কাজ করবে।”

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, “উপকূলীয় ১০ জেলায় নিরাপদ বৃষ্টির পানি সরবরাহ করতে ৯৬১ কোটি ৭৫ লাখ ৫২ হাজার টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে ২২২টি ইউনিয়নের মানুষ এর সুফল পাবে।”

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক  বলেন,সম্প্রতি এনআইএইচআর (গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ সেন্টার ফর নন কমিউনিকেবল ডিজিজেস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল চেঞ্জ) নামক গবেষণা সেন্টার চালু হয়েছে। সেন্টারটি খুলনার কয়রা ও সাতক্ষীরার আশাশুনিতে লবণাক্ততার ক্ষতি কমাতে কাজ করবে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় পানির বিষয়টি আগামী বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হবে।”