বহু বছর আগেই থেকেই সুপরিচিত ও সুমিষ্ট ফল খেজুরের চাষাবাদ হয়ে আসছে। মরুপ্রধান অঞ্চলের এই ফল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জন্য একটি সহজলভ্য খাবার।
প্রত্যেক রোজাদারের ইফতারে খেজুর থাকবে এ যেন অলিখিত এক নিয়ম! ইফতারের খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন রীতিমত নিয়ম করে রাখা হয় খেজুর। কারণ সারা দিন রোযা রাখার পর সন্ধ্যাবেলায় ইফতারে খেজুর খাবার উপকারিতার অনেক।
রোযার মাসে শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য সহায়ক খেজুর। দিনের একটি বিরাট অংশ না খেয়ে থাকার কারণে শরীরে ক্লান্তি ভাব হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তাছাড়া রোযার সময় খাবার গ্রহণের ধারা পরিবর্তিত হওয়ার কারণে শরীরের স্বাভাবিক শক্তি যোগানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইফতারের সুষম খাদ্য তালিকায় একটি সেরা সংযোজন হতে পারে এই আরব্য ফলটি।
খেজুর খেয়েই তাদের রোযা ভেঙে থাকেন অনেক রোযাদাররা। পবিত্র রমজান মাসে এই ছোট্ট ফলটির পুষ্টিগুণাগুণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খেজুরের উপকারিতাগুলো আসুন জেনে নেয়া যাক-
খেজুরের পুষ্টিগুণ
ফ্যাটহীন উচ্চ ক্যালোরি সম্পন্ন খেজুরের বেশির ভাগ ক্যালরি আসে কার্বোহাইড্রেট থেকে। খুবই অল্প পরিমাণ আসে প্রোটিন থেকে। ৮ গ্রামের একটি খেজুর প্রায় ২৩ ক্যালোরি সরবরাহ করে। ২৪ গ্রামের বড় মেডজুল খেজুরগুলোতে থাকে ৬৬.৫ ক্যালোরি। এছাড়াও খেজুর যথেষ্ট পরিমাণে ফাইবার সহ ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান সম্পন্ন।
ইউএসডিএ (ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার) অনুসারে, খেজুরে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের মধ্যে সোডিয়ামের পরিমাণ ০.২ মিলি গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ৬ গ্রাম, ফাইবার ০.৬ গ্রাম, শর্করা ৫ গ্রাম, প্রোটিন ০.২ গ্রাম, পটাসিয়াম ৫৩ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ৩.৪ মিলিগ্রাম, এবং আয়রন ০.১ মিলিগ্রাম।
একটি খেজুরে ৬ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থাকে, যার বেশিরভাগই আসে চিনি থেকে। খেজুরের মিষ্টি স্বাদের পেছনে দায়ী এতে থাকা প্রচুর পরিমাণে ফ্রুক্টোজ, যা গ্লুকোজের চেয়েও দ্বিগুণ মিষ্টি। ফল পাকার সাথে সাথে চিনির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং ফাইবার হ্রাস পায়।
খেজুরের গ্লাইসেমিক সূচক ৪৩ থেকে ৫৫ এর মধ্যে। আর এই পরিসরটি নির্ভর করে খেজুরে পরিপক্কতার ভিন্নতা এবং স্তরের উপর। সাধারণত মিষ্টি ফলগুলো উচ্চ গ্লাইসেমিকের হয়। কিন্তু খেজুরের বেলায় তা ভিন্ন। এগুলো আশ্চর্যজনকভাবে বেশ কম গ্লাইসেমিক ফল।
খেজুর পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং আয়রনের বেশ ভালো একটি উৎস। খেজুর ফোলেট এবং প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড সহ ছয়টি প্রয়োজনীয় ভিটামিন-বি সরবরাহ করে। খেজুরে রয়েছে উচ্চমাত্রার পলিফেনল, যা এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি সেলুলার ক্ষতি থেকে দেহকে রক্ষা করে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খেজুরের উপকারিতা
হজমে ভারসাম্য আনে
ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে হজমে উপকার করতে পারে। এটি পরিপাক ক্রিয়া ঝামেলামুক্ত রাখার মাধ্যমে নিয়মিত মলত্যাগে ভারসাম্য বজায় রাখে।
উপরন্তু, খেজুরের ফাইবার রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য উপকারী হতে পারে। ফাইবার হজমের গতিকে ধীর করে দেয় এবং খাওয়ার পরে রক্তে শর্করার মাত্রা খুব বেশি হওয়া রোধ করতে সাহায্য করতে পারে।
রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
খেজুরে থাকা বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুলো মূলত দেহের কোষকে ফ্রি র্যাডিক্যাল থেকে রক্ষা করে। এই র্যাডিক্যাল গুলো হচ্ছে এক ধরনের অস্থির অণু, যা শরীরে ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি এবং রোগের কারণ হতে পারে।
খেজুরে বিদ্যমান সবচেয়ে শক্তিশালী তিনটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হচ্ছে-
- ফ্ল্যাভোনয়েড, যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
- ক্যারোটিনয়েডস, যা হৃদরোগ এবং ম্যাকুলার ডিজেনারেশন বা এরকম চোখের ব্যাধিগুলোর ঝুঁকি কমাতে পারে।
- ফেনোলিক অ্যাসিড, যা প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিত। এটি ক্যান্সার এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
হাড়কে শক্তিশালী করে
ম্যাগনেসিয়ামের অভাবে অস্টিওপরোসিসের মত হাড়ের ভয়ানক রোগ হতে পারে। খেজুরে সেই ম্যাগনেসিয়ামের যোগান দাতা। সাপ্লিমেন্ট-এর মাধ্যমে ম্যাগনেসিয়াম নেয়া অপেক্ষা খেজুর খাওয়া উত্তম। এতে বিষাক্ততার ঝুঁকি কমে। অধিকন্তু, খেজুর থেকে পাওয়া আয়রন অস্থিমজ্জার স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
গর্ভাবস্থায় সুবিধা
শুকনো খেজুর গর্ভাবস্থার পরবর্তী পর্যায়ে মহিলাদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা দেয়। খেজুরের উচ্চ ফাইবার বৈশিষ্ট্য কোষ্ঠকাঠিন্য এবং অন্যান্য গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যায় সাহায্য করতে পারে।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত শুকনো খেজুর খাওয়া গর্ভধারণে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে এনে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিকভাবে গর্ভধারণের দিকে ধাবিত করতে সহায়তা করে।
দাঁতের স্বাস্থ্য সুরক্ষা
নিয়মিত খেজুর খাওয়া দাঁতের এনামেলের সুরক্ষা ও উন্নতির জন্য বেশ উপকারী। খেজুর দাঁতের ক্ষয়ের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে কারণ এতে আছে ফ্লোরাইড।
খেজুর খাওয়ার স্বাস্থ্যসম্মত উপায়
খেজুরের যাবতীয় প্রয়োজনীয় পুষ্টি লাভের জন্য প্রতিদিন ১০০ গ্রাম তথা ৪ থেকে ৬টি খেজুরই যথেষ্ট। যদিও খাওয়ার পরিমাণ ক্যালোরির চাহিদা এবং অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্যের অবস্থার উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে।
খেজুর নূন্যতম পরিমাণ প্রোটিন সরবরাহ করে। তাই দৈনন্দিন প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে অন্যান্য প্রোটিন উৎসগুলো অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যেমন চর্বিহীন মাংস, মাছ, বাদাম, এবং বীজ জাতীয় খাবার।
ইফতারিতে ২ থেকে ৩টি খেজুর খাওয়া সারাদিনের ক্লান্তিকে নিমেষেই দূর করে দিবে। এছাড়াও দেহের যাবতীয় প্রক্রিয়াসমূহকে দ্রুত কর্মক্ষম করে তুলতেও সাহায্য করতে পারে। ফাইবার, কার্বোহাইড্রেট এবং প্রোটিনের একটি সমন্বিত খাদ্য তৈরির জন্য কিছু চিনাবাদাম ও মাখনের সাথে খেজুর মিশিয়ে ইফতারির আইটেমগুলোতে রাখা যেতে পারে।
তবে খেজুর খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
দুপুর বা রাতের ভরপেট খাবার পর খেজুর খাওয়া ঠিক নয়। খেজুরে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে যা হজম হতে বেশি সময় নেয়। ফলস্বরূপ, ভরপেট খাবারের পরে প্রচুর পরিমাণে খেজুর গ্রহণ সারা শরীরে অস্বস্তিকর বোধ তৈরি করতে পারে।
খেজুরে অ্যালার্জি থাকা যদিও বিরল, কিন্তু এ যদি অ্যালার্জি থেকেই থাকে তবে খেজুর এড়িয়ে চলতে হবে। এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে একজন চিকিৎসকের সাথে কথা বলে নেয়া উচিত।
ইতোমধ্যে বেশ কিছু দিন ধরে ডায়রিয়া আক্রান্ত হলে খেজুর খাওয়া পরিহার করা উচিত। খেজুরে থাকা সরবিটল নামের চিনির অ্যালকোহলটি কিছু কিছু লোকের ক্ষেত্রে মলত্যাগের অবস্থার আরো অবনতি ঘটাতে পারে। তাই অন্ত্রের গতিবিধি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত খেজুর এড়ানো ভাল।