বহুতল ভবনের কয়েকটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালের নামে ব্যবসা খুলে বসা বর্তমানে দেশে স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু ১৯৮৭ সালে চট্টগ্রাম শহরের জাকির হোসেন রোডের খুলশীতে গড়ে উঠেছিলো রোগীদের মানসম্মত সেবা দেওয়ার একটি হাসপাতাল। হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতাল নামে ওই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উসমানড কুইয়া। ১৯৯৬ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেবার পর মূলত হাসপাতালটিরও উল্টোপথে যাত্রা শুরু হয়। একসময় বন্ধই হয়ে যায় সেটি।
উসমানড কুইয়া চট্টগ্রামে ‘মেডিক্যাল সেন্টার’ নামে প্রতিষ্ঠিত প্রথম বেসরকারি হাসপাতালেরও প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. শাহ আলম বীর উত্তম। নগরীর ও আর নিজাম সড়কে প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালটি বর্তমানে আরও সম্প্রসারিত হয়েছে।
সম্প্রতি সংক্ষিপ্ত সফরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে চট্টগ্রামে এসেছিলেন ডা. উসমানড কুইয়া। নগরীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে বিশদ কথা হয়। নিউইয়র্ক শহরে স্ত্রী ছাড়াও চার মেয়ে, এক ছেলে এবং ৯ নাতি-নাতনি নিয়ে বড় পরিবার তাঁর। উসমানড কুইয়া’র মায়ের নাম তেরেসা এন কুইয়া। যিনি ছিলেন নোবেল বিজয়ী মাদার তেরেসার সরাসরি ছাত্রী। কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন তিনি। চট্টগ্রামে বসবাসকালে তিনি সেন্ট মেরিস স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বাবা জেমস কুইয়া একটি মেডিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যালের কর্মকর্তা ছিলেন।
নটরডেম কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে (চমেক) লেখাপড়া করেন উসমানড কুইয়া। এরপর চমেক হাসপাতালেই শুরু করেন চিকিৎসা পেশা। ছিলেন ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। এরপর চিকিৎসার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। চট্টগ্রামে বেসরকারি দুই হাসপাতাল গড়ে তোলার পথিকৃৎ তিনি। এরপর সপরিবারে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে।
উসমানড কুইয়া নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিনের একজন ফ্যাকাল্টি। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি অনুমোদিত উডহুল হাসপাতালের এমবুলেটরি এডিকশন মেডিসিন এবং নিউইয়র্ক সিটি হেলথ এন্ড হাসপাতাল করপোরেশন এট কিংস কাউন্টি হাসপাতালের ফিজিশিয়ান হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। ১৯৯৬ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান।
হলিক্রিসেন্ট হাসপাতাল নির্মাণের ইতিবৃত্ত
ডা. উসমানড কুইয়া বলেন, আমার পকেটে তখন ১ টাকাও নেই। কিন্তু ১৯৮৭ সালে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে হাসপাতাল করার চিন্তা নিয়ে কাজ শুরু করি। পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর জাকির হোসেনের বড় ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলি, আপনার পাহাড়ের নীচে ৪০ গন্ডা জায়গা দেন। টাকা পরে দেবো। তিনি বলেন, এসব ছেলে দেখে এবং ছেলে আমেরিকায় থাকে। এরপর বললেন, তোমরা শুরু করো। বাকিটা আমি দেখছি। তিনি চট্টগ্রামে ভালো কিছু হোক সেটা দেখতে চেয়েছিলেন এবং আমরা দ্রুত জায়গা পেয়ে যাই।
আমরা ছিলাম তিনজন- ডা. আইনুল হক, বর্তমানে নিউজিল্যান্ড প্রবাসী ডা. আবদুল্লাহ আল হারুন আর আমি। ভাবলাম একজন বড় উদ্যোক্তা দরকার। একদিন গেলাম ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের (সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্য) কাছে। সব শুনে তিনিও সম্মত হলেন এবং আরও কয়েকজনকে অন্তর্ভুক্ত করলেন।
পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে শ্বশুর ডাকেন। বললেন; শ্বশুর, কত টাকা লাগবে? এভাবে সবাই মিলে গড়ে তুললাম হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতাল। আমরা তিনজন লেগে থাকলাম-আমি, ডা. আইনুল ও ডা. হারুন।
হাসপাতালটির সব ল্যাব পরীক্ষাই হতো চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসকরাও এখানে নিয়মিত রোগী দেখতেন। চমেক হাসপাতালের আগেই এখানে স্থাপিত হয় প্রথম আইসিইউ ও ডায়ালাইসিস মেশিন। চালু হবার পর কাউকে না জানিয়ে একদিন সেখানে হাজির হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। হাসপাতালটি দেখে তিনি মুগ্ধ হন।
চারতলা এই হাসপাতালটির নকশা করেছিলেন একজন জার্মান স্থপতি। সেইসময় বিদ্যুতের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তাই এলিভেটর ঠিকমতো চালানো যেতো না। এজন্য নির্মাণ করা হয় একটি র্যাম। জার্মান নকশাবিদ বলেছিলেন, বিদ্যুৎ না থাকলে ম্যানুয়ালি যাতে রোগীদের নীচ থেকে উপরে তোলা যায় সেজন্য র্যাম নির্মাণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামে কর্মরত বিদেশি কুটনীতিকরাও এখানে চিকিৎসা নিতেন।
প্রায় দুই দশক আগে হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে যায়। এতো আয়োজনের পরও কেনো শেষ পর্যন্ত হাসপাতালটি বন্ধ হলো? এমন প্রশ্নের জবাবে উসমানড কুইয়া বলেন, ১৯৯৬ সালে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্র চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। একদিন পিএইচপি’র চেয়ারম্যান সুফী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান আমাকে কানে কানে বললেন, শ্বশুর, আপনার বিদায় মানে হলি ক্রিসেন্টের কবর। আমি থতমত খেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কেনো এটা বললেন? সুফী মিজান বললেন, সৎ এবং আন্তরিক লোক ছাড়া এটা চালানো সম্ভব হবে না। পরবর্তীতে কর্নফুলীর হেদায়েত সাহেব এটা কিনে নেন এবং অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের দিয়ে চালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
একদিন এক কর্মকর্তা আমাকে ফিরে আসার প্রস্তাব দেন। তখন আমি বিনয়ের সাথে উনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই, কারণ ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রে আমার একটা অবস্থান তৈরি হয়ে গেছে। সন্তানদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।