প্রচ্ছদ ›› জাতীয়

‘টয়লেটের বেগ পেলেই স্কুল ফেলে ছুটতে হত বাড়ি’

আফরিন আপ্পি, খুলনা থেকে ফিরে (পর্ব-১)
০২ মার্চ ২০২৩ ১৬:২৫:৩৪ | আপডেট: ২ years আগে
‘টয়লেটের বেগ পেলেই স্কুল ফেলে ছুটতে হত বাড়ি’

মাদ্রাসায় যাওয়ার আগে বেশি পানি খেতেন না নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফারিয়া। সেখানে গিয়ে যাতে টয়লেটের বেগ না আসে সেজন্য পিপাসা পেলেও বিরত থাকতেন পানি পান থেকে। কারণ তার মাদ্রাসার একমাত্র টয়লেটটি ছিলো পুরোপুরি ব্যবহার অনুপযোগী।

ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার পর যখন আরও বেশি টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হত, তখন পরিস্থিতি কঠিন আকার ধারণ করত। বার বার টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হওয়ায় সেসময়টা মাদ্রাসায় যেত না সে। ফারিয়াদের  মাদ্রাসার প্রায়  প্রত্যেককেই যেতে হয়েছে  একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।

চার বছর আগে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার মঠবাটী জি,জি,পি,জি দাখিল মাদ্রাসার  চিত্র ছিল এটি। পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও সুপেয় পানি না থাকায় শিক্ষার্থীরা  আক্রান্ত হতেন নানা রোগে। বাধাগ্রস্ত হত স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন।

৩৫০ জন শিক্ষার্থীর এ মাদ্রাসায় ছেলে ১৭২ ও মেয়ের সংখ্যা ১৭৮ হলেও টয়লেট ছিল মাত্র একটি।

সরেজমিনে দেখা যায়; নবলোক ও ওয়াটার এইডের সহযোগিতায় ওই মাদ্রাসায় ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ২০১৯ সালে  আধুনিক শৌচাগার নির্মাণ করে দেওয়া হয়।  ফলশ্রুতিতে এখন আর বিঘ্নিত হচ্ছে না শিক্ষা কার্যক্রম। টয়লেটে রয়েছে মেয়েদের মাসিককালীন হাইজিন ব্যবস্থাপনাও।

রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং করে ব্যবস্থা করা হয়েছে সুপেয় পানির। ফলে শিক্ষার্থীরা সারাবছর পানযোগ্য পানি পাচ্ছে।

তবে ২০১৯ সালের আগে পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসফিয়া বলেন; ‘আগে স্কুলে অনেক কষ্ট হত। কলের পানি খাওয়া যেত না নোনতা লাগতো। সেজন্য আমরা পানি না খেয়ে থাকতাম। টয়লেটে যেতে পারতাম না। প্রসাব-পায়খানা চাপলে বাসায় চলে যেতাম অথবা আশেপাশে যাদের বাড়ি আছে সেখানে যেতাম। সেজন্য ক্লাসও ঠিকমত করতে পারতাম না। আবার যখন মাসিক হত তখন ৭ থেকে ৮ দিন স্কুলে-ই আসা হত না। ’

অনেকের জীবনের প্রথম মাসিক হয় স্কুলে। কিন্তু স্কুলগুলোতে এ সময় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায়  বিপাকে পড়ে শিক্ষার্থীরা। আবার অনেকের প্রায়-ই স্কুলে ঋতুস্রাব হয়। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারায় এসব ছাত্রীদের ছুটতে হয় বাড়ির পথে।

এ বিষয়ে শিক্ষিকা  আম্বিয়া আক্তার বলেন:  ‘মেয়েদের যখন মাসিক হয় তখন সরাসরি আমার সাথে কথা বলে। আমাদের এখানে প্যাডের ব্যবস্থা আছে আমি শিক্ষার্থীদের দেই। এখন আর তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না।’

নবম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী সুরাইয়া আক্তার বলেন; ‘আগে বাথরুম পেলে খুব কষ্ট হত। বাথরুম চেপে রেখে ক্লাস করতাম। মাঝে মাঝে না পেরে আশপাশের বাড়িতে যেতাম। তারা অনেকসময় বকা দিত। বাথরুমে যেতে দিতে চাইত না। ’

শিক্ষার্থীদের  হাত ধোয়ার অভ্যাস অনেক রোগের প্রকোপ কমিয়ে দিয়েছে উল্লেখ করে মাদ্রাসা সুপারিনটেনডেন্ট এসএম আমিনুল ইসলাম বলেন; ‘করোনার পর থেকে কিছুক্ষণ পর পরই ছেলে-মেয়েদের হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি সুপেয় পানি পান করায় এখন আর আগের মত ডায়রিয়া, আমাশয়, জন্ডিসের মত পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয় না তারা।’

২০২২ সালের আগস্টে  প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের ৫৪টি জেলার বিদ্যালয়ের তথ্য প্রকাশ করে। সেই তথ্যানুযায়ী দেশে বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে  ৬৫ হাজার ৫৬৬টি।

১১ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। এসব বিদ্যালয়ে ব্যবহার উপযোগী নলকূপ বা পানির কোনো উৎস নেই। ব্যবহারের উপযোগী টয়লেট নেই ৯ শতাংশ বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব তথ্য ।

মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪৮ হাজার ৪৭৪টি বা ৮৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ব্যবহারের উপযোগী নলকূপ বা পানির উৎস আছে। আর ৬ হাজার ৩৭টি বা ১১ দশমিক ০৭ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ব্যবহারের উপযোগী নলকূপ বা পানির উৎস নেই।

সংশ্লিষ্টদের মতে;  দেশের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে  ছাত্রীদের জন্য পৃথক টয়লেট নেই। থাকলেও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। অনেক স্কুলে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা আছে, কিন্তু এক গ্লাসে সবাইকে পানি পান করতে হয়। চালু থাকা টয়লেটের ভেতরে বা কাছাকাছি পানি ও হাত ধোয়ার সাবানের ব্যবস্থা থাকে না। যা মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ স্যানিটেশনের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের  গাইনীরোগ বিশেষজ্ঞ  এবং সার্জন ডা. ছাবিকুন নাহার বিজনেস পোস্ট’কে বলেন; ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের জন্য পর্যাপ্ত টয়লেট না থাকা একটি জাতীয় সমস্যা। দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব আটকিয়ে রাখার ফলে প্রস্রাবের সংক্রমণ বেড়ে যায়। এই সংক্রমণ প্রসাবের থলি থেকে ইউরেটার বা প্রসাবের নালী এবং কিডনিতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।’

‘টয়লেট না থাকলে মেয়েরা মেন্সট্রুয়াল হাইজিনও ঠিকমত মেইনটেন করতে পারে না। ফলে জননাঙ্গের ইনফেকশন, পিআইডি, ক্রনিক পেলভিক পেইন এমনকি বন্ধ্যাত্ব পর্যন্ত হতে পারে।  ঘনঘন প্রস্রাবের ইনফেকশন এবং জননাঙ্গের ইনফেকশনের ফলে প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকে। ফলে জ্বর, পেট ব্যথা ইত্যাদি সমস্যা তাদের লেগেই থাকে। পর্যাপ্ত পানি না খাওয়ায় অনেকের শরীরে পানিশূন্যতাও দেখা দেয়।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, গোপনীয়তার নীতি এবং মেয়েদের জন্য আলাদা ‍ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উপযোগী টয়লেট- এ বিষয়গুলো শিক্ষা গ্রহণের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করে। সেজন্য  দেশের প্রতিটি স্কুল, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সংশ্লিষ্ট  কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিসহ সবার অংশগ্রহণে প্রতিটি পর্যায়ে এ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে স্কুলগুলোতে উন্নত স্যানিটেশন ও সুপেয় পানির ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই বলেও মনে করছেন তারা।