সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে উপকূলে আঘাত হানার পর দুর্বল হয়ে স্থল নিম্নচাপে রূপ নিয়েছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। এতে দেশের সমুদ্র বন্দরগুলোকে বিপৎসংকেত কমিয়ে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী-শিশুসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে গাছের চাপায়। আর ২ জনের মৃত্যু হয়েছে নৌকাডুবিতে।
এদিকে, অনুমান করা সময়ের আগেই সোমবার সন্ধ্যায় ঘণ্টায় ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার বেগে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মাঝামাঝি এলাকার উপকূলে আঘাত হানে সিত্রাংয়ের অগ্রভাগ। এর আগে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, সোমবার মধ্য রাতে উপকূল অতিক্রম করে সিত্রাং।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন গতকাল রাত ৮টার দিকে বলেন, সন্ধ্যায় বাংলাদেশের উপকূল স্পর্শ করেছে সিত্রাংয়ের অগ্রভাগ। উপকূল স্পর্শ করে সিত্রাং অতিক্রম শুরু করছে। এটা মাঝারি ধরনের ঘূর্ণিঝড়; বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার।
সোমবার রাতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং সোমবার রাত ৯টায় ভোলার পাশ দিয়ে চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম শুরু করে এবং পরবর্তী তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে উপকূল অতিক্রম করে।
একই সময় আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবুল কালাম মল্লিক রাত ১টার দিকে আমাদের সময়কে জানান, ঘূর্ণিঝড়টি রাত ৯টার দিকে উপকূল অতিক্রম শুরু করে। এখন এটি দেশের প্রায় মধ্যভাগে অবস্থান করছে। উপকূল অতিক্রম করতে আরও তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগবে। সেই হিসাবে ভোর ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে এটি উপকূল অতিক্রম করার কথা।
এর আগে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে মোংলা, পায়রা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদসংকেত দেখাতে বলা হয়। এ ছাড়াও খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর ও নোয়াখালী এবং ওই এলাকার দ্বীপ ও চরগুলোকেও ৭ নম্বর বিপদসংকেত দেখাতে বলা হয়। কক্সবাজার উপকূল এবং সেখানকার চর ও দ্বীপগুলোকে দেখানো হয় ৬ নম্বর বিপদসংকেত।
ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার প্রস্তুতি সমন্বয়ে গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, ৭ হাজার ৩০টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ২৫ লাখ মানুষ থাকতে পারবেন। ঘূর্ণিঝড় সিডর ছিল সুপার সাইক্লোন, সিভিয়ার সাইক্লোনের পর আরেকটি স্তর আছে; সেটিকে বলে ভেরি সিভিয়ার সাইক্লোন, তারপর সুপার সাইক্লোন। সিত্রাংয়ের বাতাসের গতিবেগ হবে ৮০ কিলোমিটার থেকে ১০০ কিলোমিটার। সুতরাং এই গতিবেগ হওয়ার কারণে এটিকে সিভিয়ার সাইক্লোন বলা হচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সারাদেশে লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান বন্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বরিশাল বিমানবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ এলাকায় টানা বৃষ্টি হয়েছে। দিনভর বৃষ্টির ফলে ঢাকার অনেক রাস্তায় পানি জমে যায়। যানবাহনও ছিল কম। অফিস-স্কুলগামীদের পোহাতে হয় দুর্ভোগ। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয় রবিবার রাত থেকেই। সোমবার সারাদিন মুষলধারায় বৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয় বিদ্যুৎ সংযোগ। সেই সাথে গতকাল দুপুর থেকেই দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলায় ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সংযোগ ছিল না। গ্রামে থাকা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে উৎকণ্ঠায় আছেন রাজধানীতে থাকা স্বজনরা।
বরিশাল আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক মাজহারুল ইসলাম জানান, সেখানে রোববার রাত ৯টা থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আগামী দুই-তিন দিন ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন তিনি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের সময় অমাবস্যা থাকায় জোয়ারের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ থেকে আট ফুট পর্যন্ত উঁচুতে উঠতে পারে। এ কারণে দেশের উপকূলের বেশিরভাগ এলাকা ওই জোয়ারে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এর সঙ্গে ভারী বৃষ্টি যুক্ত হওয়ায় দেশের উপকূলের সব জেলায় স্বল্পমেয়াদি বন্যা হতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভুইয়া জানান, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অনেক স্থানে আকস্মিক বন্যা এবং পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মুহুরী, মুন, খোয়াই, সুরমা-কুশিয়ারা নদ-নদীর পানি বাড়তে পারে।
খুলনা বরিশাল চট্টগ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ সিত্রাংয়ের কারণে মঙ্গলবার খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান গতকাল এ তথ্য জানিয়েছেন। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আজকের সব পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলায় সতর্ক থাকার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। সোমবার বিকালে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে সব রেঞ্জ ডিআইজি, মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার, বিশেষায়িত নৌপুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ এবং উপকূলবর্তী জেলার পুলিশ সুপারদের সঙ্গে এক ভার্চুয়াল সভায় এ নির্দেশ দেন। তিনি স্থানীয় প্রশাসন এবং অন্যান্য সংস্থার সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে দুর্যোগপূর্ণ এলাকার জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
আইজিপি বলেন, দুর্যোগকালে আশ্রয়কেন্দ্র, গুরুত্বপূর্ণ অফিস ও স্থাপনাসমূহের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সময়ে উদ্ধারকারী দল, অ্যাম্বুলেন্স, জরুরি ওষুধ, ত্রাণসামগ্রী ইত্যাদি দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এ দিকে দুই মহাসড়কে যানজট। ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে গতকাল রাতে গাছ উপড়ে পড়ে ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে বন্ধ হয়ে যায়। এতে উভয় মহাসড়কে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। পুলিশ জানিয়েছে, দুটি মহাসড়কের ৮০ কিলোমিটার অংশে অন্তত ২৫টি স্থানে গাছ উপড়ে পড়ে।
চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ জানান, গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ৪১ মিলিমিটার। আর বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২ নটিকেল মাইল।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী জানান, ২৯০টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। ছুটি বাতিল করা হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) আবু তৈয়ব মো. আরিফ হোসেন বলেন, যে কোনো সেবার জন্য ০১৩২০১০৮৩৯৯ নম্বরে যোগাযোগ করার অনুরোধ করছি।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, নগরীর উপকূলীয় ওয়ার্ডগুলোতে খোলা হয়েছে ৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্র। যে কোনো সহযোগিতার জন্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ০১৬৭৪৩৫৬৯০১ নম্বরে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এদিকে সিত্রাংয়ের প্রভাবে ভোলায় গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। সকাল থেকে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ের গতিবেগ বাড়ায় আতঙ্ক তৈরি হয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে।
এরই মধ্যে অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছেন। চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ও চর কুকরি মুকরি ইউনিয়নে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ১১ হাজার মানুষ। তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করছে স্থানীয় প্রশাসন।
পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফ হোসেন জানান, জেলার প্রায় ১৬১টি পয়েন্টে ১৫ কিলোমিটারের বেশি এলাকার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাঙ্গাবালী উপজেলার চর মোন্তাজ ইউনিয়নের চর আন্ডা এলাকার তুহিন হাওলাদার (২৮) জানান, তাদের এলাকায় বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়েছে। এতে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল।