প্রচ্ছদ ›› জাতীয়

নারকেল শূন্য নারিকেল জিঞ্জিরা

রোকন উদ্দীন, সেন্ট মার্টিন থেকে ফিরে
১৭ মার্চ ২০২৩ ১৫:৩৬:২০ | আপডেট: ২ years আগে
নারকেল শূন্য নারিকেল জিঞ্জিরা
টিবিপি ছবি

দুই বছর আগেও সেন্ট মার্টিনে উৎপাদিত নারকেল ও ডাব পর্যটকদের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি করতেন এখানকার বাসিন্দারা। কিন্তু দিন দিন নারকেল বা ডাব শূন্য হয়ে পড়ছে ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ খ্যাত এই দ্বীপটিতে।

এ দ্বীপের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নারকেল গাছ রয়েছে। ‘হোয়াইট ফ্লাই’ নামের এক ধরণের সাদা মাছির আক্রমণে গাছ থেকে ঝড়ে যাচ্ছে অঙ্কুরিত ডাব। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পোকার উপদ্রব ছাড়াও অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, নতুন গাছ না লাগানো, পুরনো গাছগুলোর প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে ডাব উৎপাদন। ফলে উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় অনেক বাসিন্দা অর্থনৈতিক ধাক্কার মধ্যে পড়ছে।

হোয়াইট ফ্লাই’র উপদ্রব এবং অর্থনৈতিক ধাক্কা-

নারকেল গাছে ভরপুর বলেই সেন্টমার্টিন দ্বীপের আরেক নাম ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’। বঙ্গোপসাগরের মধ্যে ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ এই দ্বীপে যারা ভ্রমণে যান, তাদের খাদ্যতালিকায় আবশ্যিক থাকে ডাব। কারণ, এখানকার ডাবের পানি খুবই মিষ্টি এবং আকারে বড়।

সাম্প্রতি সেন্টমার্টিনে নারকেল উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় পর্যটকরা যেমন বিপাকে পড়ছেন; তেমনি স্থানীয় অনেকের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। থানা সদর টেকনাফ থেকে আমদানি করায় সেন্ট মার্টিনে এখন ডাবের দামও অস্বাভাবিক বেড়েছে। দুই বছর আগেও যে ডাবের দাম ৫০-৬০ টাকা ছিলো, সেটি এখন কিনতে গুনতে হচ্ছে ১৫০-২০০ টাকা। প্রায় তিনগুন দাম বাড়লেও বিক্রেতাদের মুনাফা থাকছে খুব সামান্যই।

পাঁচ বছর আগে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার এই দ্বীপে ডাবপ্রতি বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৫০ টাকা। আকারে বড় থাকায় প্রতিটি ডাবে গড়ে তিন গ্লাস পানি পাওয়া যেত। উৎপাদন বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত ডাবপ্রতি বিক্রি হতো ৬০-৮০ টাকা। আর এখন ডাব কিনতে হলে প্রতিটির জন্য গুনতে হচ্ছে ১৫০-২০০ টাকা। কক্সবাজার, টেকনাফসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে সরবরাহ করা এ ডাব কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি হলেও, আকারে ছোট।

দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সেন্ট মার্টিনে ডাবের উৎপাদন বন্ধ হওয়াকেই দায়ী করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা, কৃষি সম্প্রসারণ ও ক্রেতারা। আর ডাব উৎপাদন বন্ধ হওয়ার প্রধান কারণ ‘হোয়াইট ফ্লাই’ নামের এক ধরণের সাদা মাছি। এ মাছির আক্রমণে নারকেল গাছের পাতায় প্রথমে ছাই-কালো রঙের দাগ পড়ে। গাছের সবুজ রং নষ্ট হয়ে যায়। সাথে সাথে আক্রান্ত গাছের ফলন কমে আসে। এরপরে কিছু সময় পর গাছগুলো মারা যায়।

সম্প্রতি সেন্ট মার্টিন জেটিঘাট বাজার, পশ্চিম পাড়া, মাঝের পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, পূর্ব পাড়া সৈকত এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বাড়িতেই অন্তত ৫-১০টি নারকেল গাছ রয়েছে। কোন কোন বাড়িতে অর্ধশতাধিক গাছও দেখা গেছে। কিন্তু এর মধ্যে দু-একটি গাছ ছাড়া কোনটিতেই ফল দেখা যায়নি। যে দু-একটি গাছে ফল রয়েছে সেগুলোতেও সর্বোচ্চ ২-৩টি ফল রয়েছে। এছাড়াও প্রতিটি গাছের নিচে অঙ্কুরিত ডাব ঝড়ে পড়ে ছিল।

হুমকির মুখে নারকেলের স্বর্গ-

নারকেলের স্বর্গ খ্যাত এ দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া ৯নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুর রউফ দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ‘আমার বাড়িতে ২০টির বেশি নারকেল গাছ রয়েছে। দুই বছর আগেও প্রতিটি গাছেই ব্যাপক ফলন হতো। কিন্তু এখন ফুল হলেও তা অঙ্কুরিত অবস্থায় ঝড়ে পড়ছে। সাদা এক ধরণের মাছি ফল নষ্ট করে দিচ্ছে। বিষয়টি আমরা কৃষি অফিসকে জানিয়েছি, তারা ব্যবস্থা নিবে বলে আমাদের জানিয়েছেন।’

এক বাড়িতে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করেন স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস শুক্কুর। তিনি বলেন, ‘পর্যটন মৌসুমে এই বাড়িতে উৎপাদিত ডাব বিক্রি করে যে আয় হতো; তা দিয়েই আমার সংসার চলে যেত। কিন্তু এখন টেকনাফ থেকে যে ডাব আসে সেগুলোর ছড়া দাম হওয়ায় মানুষ কিনতে চায় না। তাই ডাবের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে।’

জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলার কৃষি অফিসার জাকিরুল ইসলাম দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ‘আমরা গত বছর থেকেই হোয়াইট ফ্লাই’র আক্রমণের বিষয়টি খেয়াল করেছি। এই মাছি রসালো ফলের গাছগুলোতে বাসা বাধে এবং গাছের রস খেয়ে ফেলে। তারপর তাদের বিস্টা থেকে তৈরী ছত্রাক গাছে আক্রমণ করে। এভাবে গাছের ফলন নষ্ট হয়ে যায়। বিষয়টি আমরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে জানিয়েছি।’

এর সমাধান অনেক জটিল, ব্যয়বহুল ও পরিবেশের জন্য কিছুটা ক্ষতির হওয়ায় এখনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে পর্যটন মৌসুম শেষ হলে উপজেলা অফিসের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে ফুড পাম্পের মাধ্যমে কিনটাশক প্রয়োগ করা হবে। এরপর অবস্থা বুঝে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে সেন্ট মার্টিন ইউনিয়নে মোট কতটি নারকেল গাছ রয়েছে তার কোন নির্দিষ্টি হিসাব নেই।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খানের তথ্য মতে, পাঁচ বছর আগেও পুরো দ্বীপে প্রায় ৮ হাজার ৭০০টি নারকেল গাছ ছিল। এর মধ্যে গত কয়েক বছরে আড়াই হাজারের বেশি নারকেল গাছ কেটে তৈরি হয়েছে হোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ আর বসতি।

এছাড়াও ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বিলীন হয়েছে বেশ কিছু গাছ। এখন সব মিলিয়ে ৬ হাজারের মতো নারকেল গাছ আছে। এসব গাছ থেকে বছরে তিনবার ডাব কাটা হয় বলেও জানান তিনি।

জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস দ্য বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, শুধু সেন্টমাটিনে নয়, ‘হোয়াইট ফ্লাই’র সমস্যা এখন পুরো দেশেজুড়েই। গত ৫-৬ বছর ধরে এই পোকার আক্রমণের কারণে দিন দিন নারকেল উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এজন্য কিটনাশক স্প্রে করতে যা যা প্রয়োজন তা আমাদের নেই।

বর্তমানে আমরা যে ফুড পাম্প দিয়ে নারকেল গাছে স্প্রে করি; তা দিয়ে উচু গাছগুলোতে স্প্রে করা যায়না। সেন্ট মার্টিনের অধিকাংশ গাছই অনেক পুরোনো এবং উচু। তবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র এ বিষয়ে কাজ করছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, এ দ্বীপে অপরিকল্পিত স্থাপনার কারণে নারকেল গাছের শিকড় বিস্তৃত হতে পারছে না। পাশাপাশি পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গাছ মরে যাচ্ছে। ফলে ফলন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশে ২০২০-২১ সালে মোট ৬২ হাজার ৫৭৬ একর জমিতে ডাব বা নারকেল উৎপাদন হয়েছিল। গত অর্থবছর (২০২১-২২) তা কমে ৬১ হাজার ৯৩ একরে নেমে এসেছে।