শিল্প-কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদানে পরিবেশ অধিদপ্তরে মারাত্মক অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন হয়। এর মধ্যে শিল্প-কারখানার ৬৬ শতাংশ পরিবেশগত ছাড়পত্রই অবৈধ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এ ছাড়া শিল্প-কারখানার ৫১ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ ছাড়পত্র দিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরে দুর্নীতির কারণ, উৎস, সীমাবদ্ধতা, প্রতিবন্ধকতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের গঠন করা একটি প্রাতিষ্ঠানিক টিম এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনটি কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। এটি যুক্ত করে দুদকের-২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন আকারে গতকাল সোমবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে দাখিল করেছে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন কমিশন।
প্রতিবেদনে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজে যথাযথ মান নেই বলে উল্লেখ করে এর পেছনে ৯টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি অধিদপ্তরে দুর্নীতির বেশকিছু উৎস উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ১৯টি সুপারিশ করেছে দুদক। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিবেদন আকারে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর বিষয়ে কমিশন থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে পরিবেশ অধিদপ্তরে কাজের মানের অভাব হিসেবে যে ৯টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো হলো- পরিবেশ অধিদপ্তরের কিছুসংখ্যক অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনিয়ম ও দুর্নীতি; পরিবেশ দূষণরোধে বিদ্যমান আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং শাস্তির বিধান নিশ্চিতকরণে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের অনীহা ও শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাব; অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান মালিকদের যোগসাজশ; কর্মকর্তাদের জবাবদিহির অভাব; শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে মেয়াদোর্ত্তীণ ছাড়পত্র ব্যবহার এবং ছাড়পত্র নয়ায়নে অনীহা; আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও নিরীক্ষায় ঘাটতি; পরিবেশরক্ষায় পেশাগত দক্ষতার অভাব; পরিবেশরক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত দপ্তরসমূহের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং জনসম্পৃক্ততায় ঘাটতি।
এ ছাড়া প্রতিবেদনে পরিবেশ অধিদপ্তরের দুর্নীতির বেশ কিছু উৎসও চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতি; ইটভাটার লাইসেন্স ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে দুর্নীতি; পরিবেশগত ছাড়পত্র ও নবায়নের মাধ্যমে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ; পরিবেশ বিধ্বংসী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নোটিশ দিয়ে ব্যবস্থা না নেওয়া; কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ দূষণ।
একই সঙ্গে ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরিতে দুর্নীতির আরও কিছু উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা; পরিবেশবিষয়ক জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের অভাব; রাজনৈতিক প্রভাব; ব্যবসায়িক ও মিল-কারখানা মালিকদের প্রভাব; শীর্ষস্তরের দায়িত্বশীলদের প্রতিশ্রুতির অভাব এবং দক্ষতাসংক্রান্ত প্রশিক্ষণের অভাবকে দুর্নীতির উৎস হিসেবে দেখছে দুদক।
পরিবেশ অধিদপ্তরের দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ১৯টি সুপারিশ করা হয়েছে। এতে ইটভাটাসহ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে ছাড়পত্র ও মনিটরিং সংক্রান্ত সুপারিশগুলো হচ্ছে- সব ধরনের ইটভাটা নির্মাণ ও ইট বা ব্লক প্রস্তুতের ক্ষেত্রে লাইসেন্স গ্রহণের বিধান রাখা; লাইসেন্স ও ছাড়পত্র প্রদানের আগে পরিদর্শন টিমের মাধ্যমে নিখুঁতভাবে যাচাই-বাছাই করে আইনের শর্তাবলি প্রতিপালন সাপেক্ষে লাইসেন্স ও ছাড়পত্র প্রদান করা; বিভিন্ন শিল্পকারখানা, হোটেল-মোটেলসহ বড় প্রতিষ্ঠাগুলোর ছাড়পত্র প্রদানের আগে ইটিপি স্থাপন নিশ্চিত করা, ইটিপি (বর্জ্য শোধনাগার) না থাকলে প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র ও লাইসেন্স বাতিল করা, পরির্দশন কমিটির ওপর মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করার কথাও বলা হয়েছে।
এ ছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে যেসব দুর্নীতি হয়ে থাকে সেগুলো দমনেও সুপারিশ করা হয়। সেগুলো হলো- পরিবেশরক্ষায় আধুনিক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মানের পরিবেশবিদদের মতামত গ্রহণ; প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পিপিআরের বিধান সঠিকভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করা; দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে নিরপেক্ষ পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত করা; পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো পরবর্তী সময়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করে সুষ্ঠু ও সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা; সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের অনুদানে পরিচালিত প্রকল্পসমূহ সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যথাযথ মনিটিরিং কার্যক্রম নিশ্চিত করা।
অন্যদিকে পরিবেশরক্ষায় প্রচলিত আইন ও বিধিমালায় বর্ণিত শর্তাবলির যথাযথ প্রয়োগ সাপেক্ষে এ খাতে অনিয়ম, অপরাধ ও দুর্নীতি দ্রুত চিহ্নিত করা এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শুধু জরিমানা নয়, দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে আইন প্রয়োগের বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ছাড়াও সাধারণ ক্যাটাগরিতে বেশ কিছু সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরে প্রশাসনিক স্বচ্ছতাসহ মাঠ পর্যায়ে স্বচ্ছতা অর্জনের লক্ষ্যে জাতীয় শুদ্ধাচারনীতির সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা; পরিবেশরক্ষায় পর্যাপ্ত গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে আধুনিক পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা; পরিবেশরক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর বা পরিদপ্তর ও বিভাগসমূহের মধ্যে কাজের সমন্বয় সাধন; অধিদপ্তরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
অন্যদিকে বিধিবহির্ভূত শিল্প-কারখানা স্থাপন প্রতিহত করার লক্ষ্যে শক্তিশালী মনিটরিং টিম গঠন করা; পরিবেশ অধিদপ্তরসহ পরিবেশরক্ষায় সম্পৃক্ত অন্য দপ্তরসমূহের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করে অবৈধ সুবিধার আদান-প্রদান বন্ধ করা; পরিবেশরক্ষার আন্দোলনে দেশের বিশেষজ্ঞমহলকে সম্পৃক্ত করা এবং জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণশুনানিসহ জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণে সচেতন হওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।