লন্ডনে এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে পলিইথিলিন নামক উপাদান থেকে তৈরি প্লাস্টিকের সাথে বিশ্ববাসীর প্রথম পরিচয় হয় ১৮৬২ সালে। খুব দ্রুতই এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠলো। আলেকজান্ডার পার্কসের এই উদ্ভাবনটি নির্মাণ, উৎপাদন ও প্রস্তুতকারক শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে প্লাস্টিক হয়ে উঠলো অন্যতম প্রধান প্যাকেজিং উপাদান। কিন্তু শুরুতে প্লাস্টিককে আশীর্বাদ বলে মনে হলেও এই আশীর্বাদের একটি বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
স্ট্যাটিস্টা'র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বৈশ্বিক প্লাস্টিক উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩৬৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন। আমাদের প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক উৎপাদন করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে এটি প্লাস্টিক দূষণের মতো বিশাল একটি সমস্যার সৃষ্টি করছে। প্রতি বছর, বৈশ্বিকভাবে ৩৫৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টি হয়, যার ৪০ শতাংশ আসে প্যাকেজিং থেকে, ১২ শতাংশ ভোগ্যপণ্য থেকে এবং ১১ শতাংশ টেক্সটাইল থেকে। এছাড়া, সামুদ্রিক দূষণের ৮০ শতাংশই হয় প্লাস্টিক দূষণের কারণে। প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে জমা হয়।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে সামুদ্রিক দূষণের চিত্রটি বেশ ভয়ংকর। বাংলাদেশে প্রায় ২৩০টি নদী আছে, যারা কোটি কোটি টন পলি নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলছে এবং এর সাথে যুক্ত হচ্ছে বিভিন্ন উৎস থেকে আসা বিষাক্ত বর্জ্য। দেশের টেক্সটাইল ও ডাইয়িং শিল্প কারখানাগুলো থেকে প্রতি বছর ১২.৭-১৩.৫ মিলিয়ন কিউবিক মিটার বর্জ্য পানি নির্গত হয় এবং এই বর্জ্য ২০ শতাংশ স্বাদু পানি দূষিত করে।
এই দূষণের প্রভাবও অনেক সুদূরপ্রসারী। এর কারণে উপকুলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়া থেকে শুরু করে সামুদ্রিক মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর বিষাক্ততার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকির সৃষ্টি হওয়া পর্যন্ত অনেক কিছুই হতে পারে। এছাড়াও, এর ফলে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনসে প্রবালের প্রজাতির সংখ্যা ছিল ৬৫, ২০১৬ সালে যা ৪১-এ নেমে এসেছে।
পরিবেশ রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নেয়, বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে পলিথিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। এরপর থেকে সরকার প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। পাশাপাশি, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকরী আইন প্রণয়নেরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাজারের আকার এবং প্রতিদিন সৃষ্ট দূষণের মাত্রা বিবেচনা করে, সরকারের একার পক্ষে পরিবর্তন নিয়ে আসা খুবই কঠিন।
এখানেই বেসরকারি খাতের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরী। অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন উৎপাদন ও প্যাকেজিংয়ে রিসাইক্লেবল উপাদান ব্যবহার করছে। শীর্ষস্থানীয় পানীয় কোম্পানি কোকা-কোলা ২০২৫ সালের মধ্যে বৈশ্বিকভাবে তাদের প্যাকেজিং ১০০ শতাংশ রিসাইক্লেবল করে তোলার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিকভাবে তাদের প্যাকেজিংয়ে ৫০ শতাংশ রিসাইকেলড উপাদান ব্যবহার করতেও প্রতিষ্ঠানটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আরেকটি শীর্ষস্থানীয় পানীয় কোম্পানি পেপসিকোও দক্ষিণ আফ্রিকা এবং বাংলাদেশে রিসাইকেলড প্লাস্টিক বোতল (আরপেট) চালু করেছে। ২০২২ সালের মধ্যে মিশর, কাতার, কুয়েত ও পাকিস্তানেও আরপেট বোতল চালু করতে যাচ্ছে কোম্পানিটি। রিসাইক্লিংকে বাজারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রতিষ্ঠিত দেশীয় ও বহুজাতিক এফএমসিজি এবং পানীয় কোম্পানিগুলো প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করছে। অনেক কোম্পানিই ইতোমধ্যে তাদের প্যাকেজ উৎপাদনে রিসাইকেলড উপাদান ব্যবহার করা শুরু করেছে, একইসাথে নিজেদের উৎপাদিত প্লাস্টিককে রিসাইকেলও করছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ বর্তমানে প্রতি বছর ৩০,০০০ টন প্লাস্টিক রিসাইকেল করে। সম্প্রতি ইউনিলিভার এবং ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বারস অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-র যৌথ একটি সেমিনারে রিসাইক্লিংকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমাধান হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সেমিনারে বক্তারা উল্লেখ করেন যে, উৎস পর্যায়ে বর্জ্য পৃথক করা হলে তা বর্জ্যকে রিসাইক্লিংয়ের যোগ্য করে তোলে। তবে বর্জ্য পৃথক করা এবং সুষ্ঠুভাবে বিন্যস্ত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
কিন্তু সবার প্রথমে আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে, প্লাস্টিক আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। এই প্যাকেজিং উপাদানের বিকল্প খুঁজে পেতেও আমাদের দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। প্লাস্টিকের বিকল্প এবং এই সমস্যার সমাধান খোঁজার সাথে সাথে আমাদের পরিবেশে বিদ্যমান প্লাস্টিকের পরিমাণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শীর্ষস্থানীয় পানীয় ব্র্যান্ড হিসেবে কোকা-কোলা এই সমস্যার সমাধানে বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। এমন একটি উদ্যোগ হলো কেওক্রাডং বাংলাদেশের সাথে মিলিতভাবে বার্ষিক কোস্টাল ক্লিনআপের আয়োজন করা। আন্তর্জাতিক সংগঠন ওশান কনজারভেন্সি-র বাংলাদেশ অঞ্চলের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করে কেওক্রাডং বাংলাদেশ। এই যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে গত ১১ বছরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সমুদ্রসৈকত ১৩ হাজার ৪৫০ কিলোগ্রামের বেশি সামুদ্রিক বর্জ্য পরিষ্কার করা হয়েছে। এতে অংশগ্রহণ করেন ৫ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবী। এছাড়াও, প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ এবং সার্কুলার ইকোনমি প্রতিষ্ঠার জন্য কোম্পানিটি দু’টি ভিন্ন প্রকল্পে এসআর এশিয়া ও কর্ডএইড বাংলাদেশ-এর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও বর্জ্য সংগ্রাহকদের জীবনের মান উন্নত করাও প্রকল্প দু’টির উদ্দেশ্য।
একটি বর্জ্যমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলাই আমাদের সবার লক্ষ্য। তাই সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপ এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি নীতির জোরদার বাস্তবায়ন ও তদারকির পাশাপাশি বেসরকারি খাতের আর্থিক ও লজিস্টিক্যাল সহায়তাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারে। কিন্তু সবার প্রথমে আমাদের এই সমস্যার বিষয়ে সচেতন হতে হবে। যথাযথভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণ করাও আমাদের সবার দায়িত্ব।