প্রচ্ছদ ›› জাতীয়

বদলে যাওয়া মেয়েদের গল্প

আফরিন আপ্পি
০২ অক্টোবর ২০২২ ২০:১৯:০৫ | আপডেট: ২ years আগে
বদলে যাওয়া মেয়েদের গল্প

জান্নাত। বয়স (১৩)। নীলফামারীর ডোমার উপজেলার পাঙ্গা মহেশ চন্দ্র লালা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মাস ছয়েক আগেও ভীষণ শান্ত স্বভাবের ছিলো সে। কারো সাথে ঠিকমতো কথা বলতো না। নিজেকে গুটিয়ে রাখতো সবসময়। কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানেও আগ্রহ ছিলো না বিশেষ। খেলাধুলা করতো না বললেই চলে। ছিলো না বিন্দুমাত্র আত্মবিশ্বাস। এসব কারণে জান্নাতকে নিয়ে বাবা-মাও থাকতেন বেশ দুশ্চিন্তায়।

তবে একটু একটু করে বাবা-মায়ের মনের আকাশ থেকে কেটে গেছে দুশ্চিন্তার সেই কালো মেঘ। চুপচাপ জান্নাত এখন হয়ে উঠেছে ভীষণভাবে আত্মবিশ্বাসী। কারো সাথে কথা না বলা মেয়েটি দাপিয়ে বেড়ায় পুরো স্কুল। চোখে মুখে তার আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি। সবকিছুতে অংশগ্রহণ সবার আগে। খেলাধুলা, নাচ-গান, কারাতে কোথায় নেই তার পদচারণা।

শুধু জান্নাত-ই নয়। বদলে যাওয়ার এ গল্প রংপুর ও নীলফামারীর শত শত কিশোরীর। আজ আপনাদের শোনাবো সেই গল্প।

আবার ফেরা যাক জান্নাতের কথায়। বিজনেস পোস্টের সাথে আলাপকালে জান্নাত জানান, ‘সম্প্রতি তাদের বাসায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। সেখানে বাইরের কিছু বখাটে ছেলে উপস্থিত ছিলো। এর মধ্য থেকে একজন তার সাথে অশালীন আচরণের চেষ্টা করে। তবে সৌভাগ্যবশত জান্নাতের ‘কারাতে’ প্রশিক্ষণ থাকায় তিনি ওই ছেলেকে প্রতিহত করতে সক্ষম হন।’

রংপুর ও নীলফামারীর শত শত কিশোরী এই কারাতে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন বলিষ্ঠভাবে কথা বলছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সহিংসতা রুখে কীভাবে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে হবে সে বিষয়েও সচেতন তারা।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও অস্ট্রিয়ান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশনের অর্থায়নে কেয়ার বাংলাদেশ ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কারিগরি সহায়তায় এবং ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) কর্তৃক বাস্তবায়নকৃত জয়েন্ট অ্যাকশান ফর নিউট্রিশন আউটকাম (জানো) প্রকল্পের আওতায় কারাতে শিখছেন কিশোরীরা।

বাংলাদেশ সরকারের দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ‘জানো’ সরকারের সহায়ক প্রকল্প হিসেবে কাজ করছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত।

প্রকল্পের আওতায় ১৭৫ জন ছাত্রীকে আত্মরক্ষার কৌশল বিষয়ক ৩২ দিনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে প্রকল্প এলাকার ৭টি উপজেলায়; রংপুর জেলার তিন উপজেলা (গংগাচড়া, কাউনিয়া ও তারাগঞ্জ) ও নীলফামারী জেলার চার উপজেলা (নীলফামারী সদর, ডোমার, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ)-এ প্রশিক্ষণ পরবর্তী সমাপনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিশোরীদের সনদ ও বেল্ট প্রদান করা হয়।

তবে এতটাও সহজ ছিলো না এ কর্মযজ্ঞ। প্রথমদিকে শিক্ষার্থীদের এ কার্যক্রমের আওতায় আনতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। বিষয়টি একেবারেই নতুন হওয়ায় প্রশিক্ষণে অংশ নিতে চাইতো না অনেকেই।

মূল চ্যালেঞ্জটা কী ছিলো জানতে চাওয়া হলে জানো প্রকল্পের স্কুল ভলান্টিয়ার (ইএসডিও) মেরিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘স্কুলে স্কুলে গিয়ে প্রথমে শিক্ষার্থীদের বোঝাতেই অনেক সময় লেগেছে। দেখা যেতো এক থেকে দুইজন শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করতো। অনেকে আবার প্রথম দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে দ্বিতীয় দিন আসতে চাইতো না। ভুগতো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। তবে এই শিক্ষার্থীরাই যখন প্রশিক্ষণ শেষ করে এসেছে তখন তাদের দেখে বাকিরাও আগ্রহী হয়েছে। এখন রুমে জায়গা দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।’

ডোমার উপজেলার সোনারায় উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাইশা ও মেফতাহুল। তারা দুই বোন। মাইশা পড়েন নবম শ্রেণিতে আর মেফতাহুল ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। এই দুই বোন ‘জানো’ প্রকল্পের আওতায় একসাথে কারাতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

কারাতে শিখে তাদের জীবনে কী পরিবর্তন এসেছে এ প্রশ্নের উত্তরে মাইশা বলেন, ‘আগে কোনো কাজে আত্মবিশ্বাস পেতাম না। কারাতে শেখার পর থেকে সেই আত্মবিশ্বাসটা পেয়েছি। এর ফলে যে কোনো কাজ শুরুর আগে আমি দৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ হতে পারি এবং সেই কাজে সফলতা পাই।’

বড় বোনের সাথে সুর মিলিয়ে মেফতাহুল বলেন, ‘আমি এখন অনেক আত্নবিশ্বাসী। আমার আগে রাস্তায় চলতে ভয় করতো। কিন্তু এখন আর তেমন হয় না। আমি জানি আমার আত্মরক্ষার কৌশল জানা আছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করা আমার জন্য সহজ।’

এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মেয়েরা সহিংসতার বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাব দিতে শিখছে উল্লেখ করে ডোমার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ রমিজ আলম বিজনেস পোস্টকে বলেন, ‘কারাতে প্রশিক্ষণ শুরুর দিনে মেয়েদের মাঝে যে জড়তা বা আড়ষ্টতা দেখেছি; তার বিন্দুমাত্র ছিল না যেদিন তাদের সনদপত্র ও বেল্ট দিলাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মেয়েরা শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছে। আমার মনে হয় মেয়েদের যে আত্মরক্ষার কৌশল সেটি তারা ভালোভাবে রপ্ত করেছে। এর মাধ্যমে প্রতিরোধ ও প্রতিকার দুটোই শিক্ষা পাচ্ছে তারা। শুধু তাই নয় নিজেরা শিখে তাদের সহপাঠীদের শেখাচ্ছে। পাশের স্কুলগুলোতে গিয়ে শেখাচ্ছে। এর ফলে প্রোগ্রাম করে শেখানোর যে দীর্ঘসূত্রিতা সেটি কমে যাবে এবং স্বল্প সময়ে অনেক মেয়ে আত্মরক্ষার কৌশল শিখতে পারবে।’

বর্তমানে ১০টি স্কুলের শিক্ষার্থীরা এ প্রশিক্ষণ পেয়েছে। বাকি স্কুলগুলোতেও প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ‘জানো’ প্রকল্পের। স্কুলগুলোতে টিফিনের ফাঁকে ৩০ মিনিট করে কারাতে শেখায় প্রশিক্ষিত শিক্ষার্থীরা। এজন্য তাদেরকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে আলাদা রুম।

মেয়েরা ৩২ দিনের যে কারাতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে সেগুলোর প্রতিটি ক্লাসের ভিডিও ফুটেজ তৈরি করা হয়েছে। স্কুলগুলোতে সেই ভিডিও দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখন সেশন ধরে ধরে কৌশলগুলো রপ্ত করছে।

সহপাঠীদের এ আত্মরক্ষার কৌশল শিক্ষাকে কীভাবে দেখছে ছেলেরা এ বিষয়ে কথা হয় কয়েকজন ছেলে শিক্ষার্থীর সাথে।

বিজনেস পোস্টকে তারা জানান, ‘শুধু মেয়েরাই কারাতে শিখছে। তবে আমরাও শিখতে চাই। না হলে আমরা ওদের থেকে পিছিয়ে পড়বো। তাই আমরাও চেষ্টা করি ভিডিওগুলো দেখে দেখে কারাতে শেখার।’

অপরদিকে মেয়েরা জানান, ‘সহপাঠী ও উপর ক্লাসের ছেলে শিক্ষার্থীরা এখন তাদের বেশ সমীহ করেন। আগে যারা উত্যক্ত করতো তারাও এখন বেশ সচেতন। এখন আর কেউ ভিন্ন চোখে তাকানোর সাহস পায় না।’

মেয়েদের এই পরিবর্তনে খুশি তাদের বাবা-মায়েরাও। পাঙ্গা মহেশ চন্দ্র লালা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আবু জাফর সামসুদ্দিন বলেন, ‘আমার মেয়ে কারাতে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর থেকে মেয়ের ভেতরে আমি অভাবনীয় পরিবর্তন দেখেছি। যে মেয়ে আগে কারো সাথে কথা-ই বলতে চাইতো না সেই মেয়ে এখন নিজের সব বিষয়ে অনেক সোচ্চার। সবকিছুতে তার অংশগ্রহণ ও সফলতা যেভাবে বেড়েছে বাবা হিসেবে সেটি আমাকে গর্বিত করে।'

বিদ্যালয়ে এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে কী-না এ প্রশ্নের উত্তরে এই প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘প্রথমে শিক্ষার্থীরা ভয় পেতো। প্রশিক্ষণ নিতে আসতে চাইতো না। বাবা-মায়েরা আগে মেয়েদের কারাতে শিখতে দিতে ভয় পেলেও পরে যখন তারা বুঝতে পেরেছে- এর মাধ্যমে মেয়েরা ছেলেদের সাথে সমানতালে এগিয়ে যেতে পারবে, তখন তারাও আগ্রহী হয়েছেন।’

কারাতে প্রশিক্ষণ কিশোরীদের আরও বেশি ফিট করে তোলে উল্লেখ করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গর্ভবতী, প্রসূতি, স্ত্রী ও গাইনিরোগ বিশেষজ্ঞ ছাবিকুন নাহার বিজনেস পোস্টকে বলেন, ‘বর্তমানে মুটিয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা শিশু-কিশোরদের রয়েছে; সেটি রুখতে কারাতে খুব উপকারী। এর মাধ্যমে বাচ্চাদের ফিজিক্যাল ফিটনেস বাড়ে। সবকিছুতে তারা আত্মবিশ্বাস পায়।’

একটি সুস্থ প্রজন্ম ফিট হয়ে বেড়ে উঠলে পরবর্তীতে তাদের বাচ্চারাও সুস্থ সুন্দর জীবন পাবে। কারাতে শিক্ষার ফলে মেয়েদের বৈবাহিক জীবন বা সন্তান ধারণে শারীরিক কোনো সমস্যা হয় না বলে মন্তব্য করেন এ চিকিৎসক।

তবে কারাতের পাশাপাশি সুষম খাবার গ্রহণের প্রতিও জোর দিয়েছেন তিনি।

মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শিক্ষায় নীলফামারী ও রংপুর জেলাকে রোল মডেল ধরে সারাদেশে এই কার্যক্রম ছড়িয়ে দেয়ার উপর জোর দিয়েছেনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাজিয়া আরিফা।

বিজনেস পোস্টকে তিনি বলেন, ‘‘বর্তমান সরকারের পুষ্টি ফলাফলের জন্য যৌথ পদক্ষেপ ‘জানো’ প্রকল্পটি বিশেষত মেয়ে শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের পুষ্টির চাহিদা পূরণে সচেতনতা বৃদ্ধিতে নীলফামারী ও রংপুর জেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ প্রকল্পে নারীদের সুস্থতার পাশাপাশি আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে কারাতে প্রশিক্ষণের উপর যে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, সেটি শুধু এ দুই জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাংলাদেশের অন্যান্য জেলায়ও ছড়িয়ে দিতে হবে। ফলাফলস্বরুপ এটি বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার নারীদেরও আত্মবিশ্বাসী ও শক্তিশালী করে তুলতে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।’’

তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণত বাংলাদেশের নারীরা ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, যৌতুক সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়। এমনকি শহর-গ্রাম, ও ঘরে বাইরে সব জায়গায় নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। সরকারের এই কারাতে প্রশিক্ষণ পদক্ষেপের মাধ্যমে নারীরা সমাজে তাদের সম অধিকার নিশ্চিত করে এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা থেকে নিজেদের রক্ষা করে সমাজের উন্নয়নমূলক কাজে অবদান রাখতে পারবে।’

তবে শুধু আত্মরক্ষার কৌশল শিক্ষাই নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতভাবে সহিংসতার রুখতে পারবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত পুরুষশাসিত সমাজে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তীত না হবে; বলে মন্তব্য করেন এ বিশেষজ্ঞ।