প্রচ্ছদ ›› জাতীয়

বাড়ছে পেশাদার কসাইয়ের চাহিদা

রোকন উদ্দীন
২৪ জুন ২০২৩ ১৭:৩৮:৪২ | আপডেট: ২ years আগে
বাড়ছে পেশাদার কসাইয়ের চাহিদা

দেশে প্রতিবছরই বাড়ছে কোরবানির সংখ্যা। সেই সাথে বেড়েছে পেশাদার কসাইদের চাহিদাও। যার ফলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে এ পেশা। বিভিন্ন খামার থেকে দেয়া হচ্ছে কসাই সাপ্লাইয়ের সুবিধা, গড়ে ওঠছে অনলাইন পেজও। ভাল আয় হওয়ায় যুবকরা অন্যান্য পেশার পাশাপাশি বেছে নিচ্ছেন মৌসুমি এই পেশাকে।

তবে দিন দিন যে হারে চাহিদা বাড়ছে সে হারে প্রশিক্ষিত বা পেশাদার কসাইয়ের সংখ্যা বাড়ছে না। এতে অতিরিক্ত ফি গুণতে হচ্ছে কোরবানিদাতাকে। যারা পেশাদার কসাইদের অতিরিক্ত ফি দিয়ে নিতে পারছেন না তারা অপেশাদার বা মৌসুমি কসাইদের দিয়েই কোরবানির কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। এর ফলে প্রভাব পড়ছে চামড়া ও মাংসের মানে।

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত বছর দেশে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়াসহ প্রায় সাড়ে ৯৯ লাখ পশু কোরবানি হয়েছিল। যা আগের বছর ছিল ৯০ দশমিক ৯৩ লাখ। চলতি বছরে ১ কোটি ৪ লাখ পশু কোরবানি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ৪২ লাখ বা ৪০ শতাংশই গরু ও মহিষ।

বিভিন্ন পেশাদার কসাইদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি পশু জবাই ও প্রক্রিয়াজাত করতে ৩-৫ জন পেশাদার বা প্রশিক্ষিত কসাইয়ের একটি গ্রুপ প্রয়োজন হয়। তারা ২ থেকে ৩ ঘণ্টায় একটি পশু জবাই করে চামড়া ছাড়িয়ে মাংস প্রক্রিয়াজাত করতে পারেন এবং একটি গ্রুপ দিনে কমপক্ষে দুটি পশু প্রক্রিয়াজাত করতে পারেন। এই হিসাবে দেশে কোরবানির দিন ৬৩ লাখ থেকে ১ কোটি পেশাদার বা প্রশিক্ষিত কসাইয়ের প্রয়োজন।

বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য মতে, দেশে প্রায় ৬ লাখ মাংস ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাদের দোকানে কসাই হিসেবে কাজ করেন প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিক।

এছাড়া প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত মোট ১ লাখ পেশাদার ও অপেশাদার ব্যক্তিকে পশু জবাই, চামড়া ছাড়ানো ও মাংস কাটার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সে হিসাবে দেশে প্রশিক্ষিত ও পেশাদার কসাইয়ের ঘাটতি রয়েছে ৪৮-৮৫ লাখ। তবে গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ কোরবানিদাতা নিজেরাই পশু জবাই ও প্রক্রিয়াজাত করেন।

জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডাঃ মোঃ এমদাদুল হক তালুকদার দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, আমরা প্রতিবছরই কসাইদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত ১ লাখ কসাইকে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি। চলতি বছর ৩১ হজার ৭৯৯ জন পেশাদার-অপেশাদার কসাইকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অনেকে একাধিকবারও প্রশিক্ষণ পেয়েছে। তবে হঠাৎ করে বা দু-এক বছরে এই বিশাল চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়, তবে ধীরে ধীরে করা যাবে।

যারা কোরবানি দেন তারা ঈদের দিন এক সঙ্গে চাপ তৈরি না করে পরের দু’দিন কোরবানি দিতে পারেন। এছাড়া নিজেরাও প্রক্রিয়ার কাজে অংশ নিলে এই চাপ কমে আসবে বলে জানান তিনি।

পেশাদার কসাইয়ের চাহিদা বাড়তে থাকায় আগ্রহী হয়ে ওঠছেন অনেক যুবক। বিচ্ছিন্ন ভাবে পাড়া-মহল্লায় কাজ করলেও অনেকেই বিভিন্ন নামে এটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছেন। ওয়েব সাইট বা ফেসবুক পেজ খুলে কসাই সাপ্লায়ের কাজ করছেন।

তারা নির্দিষ্ট ফি’র বিনিময়ে ঈদের তিন দিন পশু জবাই থেকে শুরু করে মাংস প্রক্রিয়া ও বাসায় পৌছে দেয়ার কাজ করেন। এ ক্ষেত্রে মোবইল বা ফেসবুকে যোগাযোগ করে আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো সময়ের স্লট ভিত্তিক বুকিং নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ফি’র কিছু পার্থক্য হয়।

এসব পেশাদার কসাই সাপ্লাই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি হাজারে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা নিয়ে থাকে। অর্থাৎ এক লাখ টাকা দামের কোরবানির পশু জবাই, চামড়া ছাড়ানো ও মাংস প্রক্রিয়াজাত করার জন্য তাকে খরচ করতে হবে ১৫-২০ হাজার টাকা। তবে ঈদের পর দিন ফি কিছুটা কম হয়।

জানতে চাইলে ‘বুচার শপ বা কসাই সাপ্লাই’ নামের একটি ফেসুবক পেজের সত্ত্বাধিকারী মো. সুলাইমান হোসেন দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, আমি ২০১৬ সাল থেকে কসাই সপ্লাইয়ের কাজ করি। শুরুতে আমার গ্রুপে পেশাদার কসাই ছিল ৫০ জন। এখন প্রায় ১৫০ জনের মতো কসাই রয়েছে। আমি গত বছর ১২৩টি পশু প্রক্রিয়ার সার্ভিস দিয়েছি।

তিনি বলেন, এবছর আরও বাড়বে বলে আশা করছি। চলতি বছর ইতিমধ্যে ঈদের দিনের জন্য ৩০-৩২টি বুকিং হয়েছে। এছাড়া ঈদের পর দিন রয়েছে আরও কয়েকটি। আমরা ঈদের দিন সকালের জন্য প্রতি হাজারে ১৮০ টাকা ও ঈদের দিন বিকালে ১৫০ টাকা করে ফি নিচ্ছি।

তবে যারা প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে পাড়া-মহল্লায় কয়েকজন মিলে এই সার্ভিস দিয়ে থাকেন তারা ফি নেন পশুর সাইজ অনুসারে। এক্ষেত্রে সাইজ অনুসারে ৮-১৫ হাজার টাকা নেন তারা। এই ফি’কে অতিরিক্ত মনে করছেন অনেকে। তারা বলছেন, একজন মাংস শ্রমিক সারা দিন কাজ করে যা আয় করেন এই ফি তার চার থেকে ৫ গুন। অতিরিক্ত ফি হওয়ায় অনেকে পেশাদার কসাই দিয়ে কোরবানির কার্যক্রম করতে আর্থিক চাপে পড়েন। এছাড়া অনেকে নিরুসাহিত হয়ে অপেশাদার শ্রমিক দিয়ে কোরবানি করেন।

তারা আরও বলেন, দেশে পেশাদার কসাই বা মাংস শ্রমিকের তীব্র ঘাটতি দেখা দেয় কোরবানির তিন দিন। ঈদের দিন একজন পেশাদার কসাই পাওয়া প্রায় দুষ্কর। আর পাওয়া গেলেও বিপুল পারিশ্রমিক দিতে হয়।

বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব মো. রবিউল আলম বলেন, সমিতির সদস্যদের মধ্যে যারা বিভিন্ন স্থানে কোরবানির পশুর মাংস প্রস্তুতকরণ কাজে যুক্ত থাকেন, তারা পশুর সাইজ বুঝে ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন।

তিনি বলেন, দেশে কোরবানি বেশি হওয়ায় এবং চাহিদার তুলনায় মাংস শ্রমিক কম থাকার সুযোগ নিয়ে মাংস ব্যবসায়ীরা। তারা সমিতির বাইরেও বিচ্ছিন্নভাবে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে খামারিরা নিজেদের মতো করে মাংস শ্রমিক তৈরি করছেন। মূলত তারাই এই অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দাবি করে থাকেন। অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে অর্ডার নিয়ে কসাই সাপ্লাই দেন। কেউ আবার অনলাইনে পশু কিনে তাদের প্রতিষ্ঠানের কসাই দিয়েই মাংস প্রস্তুত করে আনেন।

রাজধানীর রামপুরা এলাকার বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, প্রতি বছর কোরবানির পশুর দাম বাড়ছে, তার উপর প্রক্রিয়াকরণে অতিরিক্ত ফি যোগ করলে মধ্যবিত্তদের কোরবানি দেয়াই বন্ধ হয়ে যাবে। আমি গত বছরও কোরবানির জন্য পেশাদার কসাই খুঁজেছি। কিন্তু যাদের পেয়েছি তারা এতো বেশি ফি চেয়েছে তা আমার কাছে অনেক বেশি মনে হয়েছে। তাই স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে যারা মৌসুমে কোরবানির পশু প্রক্রিয়াকরণে কাজ করেন তাদের দিয়েই কোরবানির পশু প্রক্রিয়া করেছি। এবছরও তারা করতে চাইছেন কি করবো এখনও কোন সিদ্ধান্ত নিইনি।