প্রচ্ছদ ›› জাতীয়

বাড়তি সক্ষমতা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ আমদানি কেন?

আশরাফুল ইসলাম রানা
০২ মার্চ ২০২৩ ২০:৩৩:০৯ | আপডেট: ২ years আগে
বাড়তি সক্ষমতা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ আমদানি কেন?

চলতি অর্থবছরে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে সরকারের প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। অন্যদিকে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ৪০ শতাংশই অলস পড়ে রয়েছে, যেখানে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে সরকার।

একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কারণে দেশে ঋণের বোঝা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফলে সরকার ঘন ঘন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দাম বাড়াচ্ছে, যা জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এর মধ্যে আদানি গ্রুপের উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ আমদানি নিয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ আমদানির প্রয়োজন আছে কিনা সেই পুরনো প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

এদিকে, বিদ্যুৎ আমদানির ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যে চারটি চুক্তির অধীনে ভারতের সরকারি ও বেসরকারি খাত থেকে প্রতিদিন ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে, তা এখনও সাশ্রয়ী মূল্যের। তবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি করা বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ৬ টাকা থেকে বেড়ে ৮ দশমিক ৫৬ টাকার বেশি হয়েছে।

বিপিডিবির কোম্পানি বিষয়ক বিভাগ সম্প্রতি দ্য বিজনেস পোস্টকে জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ এই সংখ্যা ১০ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম এবং খনিজ সম্পদ প্রকৌশলের অধ্যাপক মোহাম্মদ তামিম, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিকে সমর্থন করেন। তবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রথমে দামি তেল এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা উচিত কারণ এগুলো বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আদানি কয়লার জন্য পায়রা এবং রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বেঞ্চমার্ক মূল্য (প্রতি টন ১৯০-২৪৫ ডলার ৫৫০০ হিটিং মূল্য) এর চেয়ে বেশি সরকারকে দেয়া উচিত নয়। বিকল্প হিসাবে,  বিপিডিবি নিজেই গড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য কয়লা সরবরাহ করতে পারে।

ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় আদানি গ্রুপের ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশে তার প্রথম ৭৫০ মেগাওয়াট ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করবে। কিন্তু কোম্পানিটি প্রতি টন ৪৬০০ ক্যালোরিফিক কয়লার দাম ৪০০ ডলার দাবি করায় আপত্তি জানিয়েছে বিপিডিবি। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম ২০০ ডলারের নিচে। যা নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনা শুরু হয়েছে।

বিপিডিবি বলছে, প্রতি টন কয়লার জন্য ৪০০ ডলার দিলে গোড্ডা প্ল্যান্ট থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ২৫ টাকার বেশি হবে। আর এই দামে আমরা বিদ্যুৎ কিনতে রাজি না। তাই আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে সরকার।

বিদ্যুৎ সচিব হাবিবুর রহমান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এমনকি বিপিডিবির কর্মকর্তারাও স্পর্শকাতর হওয়ায় এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি। তবে বিদ্যুৎ সচিব এবং বিপিডিবির দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভারতের পাবলিক সেক্টর থেকে চলমান বিদ্যুৎ আমদানিকে সমর্থন করেন।

বুয়েটের সাবেক রাসায়ন প্রকৌশল অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আগে বন্ধ না করলে আমদানি করা বিদ্যুতের সুষম ও যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে না।

কতটা ব্যয়বহুল হচ্ছে আমদানি বিদ্যুৎ?

২০১৬ পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী, সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে প্রতিবেশী ভারত, নেপাল এবং ভুটান থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করার পরিকল্পনা করেছে।

এই পরিকল্পনার অংশ হিসাবে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ২০১৩ সালে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়, যার পরিমাণ ছিল প্রতিদিন ১৭০ মেগাওয়াট। বর্তমানে ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। যারমধ্যে ২৫০ মেগাওয়াট সরকারি খাত থেকে এবং ৯১০ মেগাওয়াট বেসরকারি খাত থেকে।

বিপিডিবি বলছে, ভারতের বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট মূল্য চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ ১০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যা এখন ৮.৫৬ টাকা। সাম্প্রতিক ডলারের দাম বৃদ্ধির আগে বাংলাদেশকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে খরচ করতে হতো ৬ টাকা।

অন্যদিকে, ভারতের বেসরকারি খাত থেকে কেনা বিদ্যুতের দাম পড়ে প্রতি ইউনিট ৫.৫ টাকা। ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুসারে চলতি বছর পর্যন্ত যা একই থাকবে।

বিপিডিবির অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, ২০২২ অর্থবছরে প্রায় ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভারত থেকে ৭৭০ কোটি কিলোওয়াট-আওয়ার বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছে।

বিপিডিবির পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ যখন বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা কম ছিল।

তিনি বলেন ‘আমাদেরও সেই সময়ে যে কোনও উপায়ে বিদ্যুতের প্রয়োজন ছিল এবং আমরা তা সস্তা পেয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখন জ্বালানির দাম বেড়েছে। এই জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি কীভাবে বিদ্যুতের দামকে প্রভাবিত করবে তা এই মুহুর্তে বলা কঠিন’ ।

তার মতে, আদানি গ্রুপ থেকে আমাদের আমদানি যুক্তিসঙ্গত । তবে জ্বালানির দাম সমন্বয় করতে হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে আদানি গ্রুপের গতিবিধি পর্যবোক্ষণকারী সংস্থা আদানি ওয়াচের মতে, বাংলাদেশকে প্রতি বছর আদানি গ্রুপকে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি দিতে হয়, যার মধ্যে উচ্চ ক্ষমতার অর্থপ্রদান, কয়লার মূল্য, জ্বালানি সিস্টেমের ক্ষতি এবং কর সংযুক্ত রয়েছে। এই  বিবেচনায়, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম দাঁড়াবে ২৫ টাকা, যা দেশের দামি ডিজেলচালিত প্ল্যান্ট থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিদ্যুতের দাম হবে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ইজাজ বলেন, বাংলাদেশের সংকট বিবেচনায় ভারতীয় বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি, এটি একটি আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য পরিকল্পনা ছিল।

তিনি আরও বলেন, শুরুতে আমরা বলেছিলাম বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা ভুল। আমরাও বলেছি আমাদের আমদানি নীতি ভুল। এ কারণেই সরকার প্ল্যান্টের পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেনি যখন আমরাও বিদ্যুৎ আমদানির বোঝা বহন করছি।

বিপিডিবির সদস্য এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার বলেন, ‘আমরা চাইলেও সব বিদ্যুৎকেন্দ্র তাদের পূর্ণ ক্ষমতায় চালাতে পারি না কারণ আমাদের জ্বালানি সংকট রয়েছে। এ কারণেই বিদ্যুৎ আমদানি নিরাপদ’।

নতুন এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কি নতুন বিপদ?

বিপিডিবি বলছে, দেশে মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ১৫৪টি এবং ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৩টি প্ল্যান্ট নির্মাণাধীন রয়েছে। এর মধ্যে সাতটি এলএনজি-ভিত্তিক যার সম্মিলিত ক্ষমতা ৩ হাজার ৮৫১ মেগাওয়াট। এই সাতটির মধ্যে ভারতীয় রিলায়েন্স গ্রুপের ৭১৮ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন মেঘনাঘাট প্ল্যান্টও রয়েছে।

বিপিডিবি তথ্য অনুসারে, নির্মাণাধীন এলএনজি-ভিত্তিক প্ল্যান্টগুলো আগামী বছরের মধ্যে উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হবে। তবে ইতোমধ্যেই নিজস্ব গ্যাসের ঘাটতি ছাড়াও, সরকার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করতে হিমশিম খাচ্ছে।

অধ্যাপক ইজাজ বলেন, এলএনজিভিত্তিক নতুন কেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ খাতে নতুন বিষফোঁড়া হয়ে উঠবে। বর্তমানে পাকিস্তান যেমন বিদ্যুৎ সংকটে রয়েছে, বাংলাদেশও সেই ঝুঁকির মুখে রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এই ঝুঁকি এড়াতে কর্তৃপক্ষকে ‘বিদ্যুৎ নেই, খরচ নেই’ নীতি গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন অধ্যাপক ইজাজ।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ চাহিদা ১৪ হাজার   মেগাওয়াট (গ্রীষ্মকালে), অর্থাৎ ১০ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট অব্যবহৃত রয়ে গেছে। তবে ট্রান্সমিশন লাইনের সীমাবদ্ধতা এবং জ্বালানি সংকটের কারণে পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না, যদিও এই খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে সরকার।