সদ্য প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়েছে রাইসা (ছদ্মনাম)। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এক কিশোরী। একদিন স্কুলে গিয়ে হঠাৎ দেখতে পায় সহপাঠীরা তাকে নিয়ে কী যেনো বলাবলি করছে। একে অপরকে ডেকে রাইসাকে দেখাচ্ছে। এরই মাঝে বিদ্যালয়ের উপরের শ্রেণির এক শিক্ষার্থী তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে পরামর্শ দেন বাসায় চলে যাওয়ার।
বাসায় ফিরে চমকে ওঠে রাইসা; দেখতে পায় রক্তে লাল হয়ে গেছে স্কুলের সাদা পোশাক। এ রক্তের কারণ খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে সে। ভয়ে আশপাশের কাউকে কিছু বলার সাহস পায় না। তবে সবার চোখ এড়াতে পারলেও মায়ের চোখে ঠিক-ই ধরা পড়ে যায়।
মা রাইসাকে জানান; এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সব মেয়েদেরই এমন হয়। তবে সেইসাথে জুড়ে দেন বিধি-নিষেধের নানা শৃঙ্খল।
বিষয়টি কোনওভাবেই মানতে পারে না রাইসা। প্রাণবন্ত মেয়েটি দিন দিন হয়ে পড়ে বিমর্ষ-মনমরা। ঠিক কী কারণে রাইসাকে ওইদিন বাসায় যেতে বলা হয়; বেঁধে দেয়া হয় বিধি-নিষেধের বেড়াজালে। সেদিন বুঝতে না পারলেও এখন ঠিকই বোঝে সে। আর তাই রাইসা চায় না তার মতো এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হোক তার ছোট বোন বা প্রতিবেশী কিশোরীরা।
কৈশোরে এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি এমন নারী খুঁজে পাওয়া ভার। এ অবস্থায় কীভাবে নিজেদের সামলে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হতে হবে; সে শিক্ষাই দিচ্ছে রংপুর-নীলফামারির অ্যাডোলেসেন্ট ক্লাব ও কর্নারগুলো।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও অস্ট্রিয়ান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশনের অর্থায়নে কেয়ার বাংলাদেশ ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কারিগরি সহায়তায় এবং ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) কর্তৃক বাস্তবায়নকৃত জয়েন্ট অ্যাকশান ফর নিউট্রিশন আউটকাম (জানো) প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে এ কার্যক্রম। এর মধ্যে অন্যতম হলো কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন শিক্ষা।
বাংলাদেশ সরকারের দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ‘জানো’ সরকারের সহায়ক প্রকল্প হিসেবে কাজ করছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত।
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন দেখা যায়। তাদের আবেগীয় যে পরিবর্তনগুলো আসে সে বিষয়ে জানানো হয় অ্যাডোলেসেন্ট ক্লাব ও কর্নারগুলোয়। কীভাবে তারা এ পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে পরবর্তীতে সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপন করতে পারবে সে বিষয়ে দেয়া হয় শিক্ষা।
এ প্রকল্পের আওতায় রংপুর ও নীলফারির ৪ লাখ ২১ হাজার ৪২৫ জন কিশোর-কিশোরীকে সেবা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। প্রকল্প এলাকার ৭টি উপজেলা; রংপুর জেলার তিন উপজেলা (গংগাচড়া, কাউনিয়া ও তারাগঞ্জ) ও নীলফামারী জেলার চার উপজেলায় (নীলফামারী সদর, ডোমার, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ)-এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে এ দুই জেলার ৩৩০টি স্কুলে অ্যাডোলেসেন্ট কর্নার রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক ভিডিও, খেলাধুলার মাধ্যমে বয়ঃসন্ধিকালের পরিবর্তন, মাসিক ব্যবস্থাপনা ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, স্বপ্নদোষ, আবেগ অনুবাধন, আবেগ ব্যবস্থাপনা, মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা ও কৈশরকালীন পুষ্টি বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হয়। এছাড়া মাদকমুক্ত থাকার কৌশল ও এইডসসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের শিক্ষা দেয়া হয়।
উপজেলায় অবস্থিত কমিউনিটি ক্লিনিক, বিদ্যালয়ের কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপ, স্কুল ইন্টারভেনশন, শিক্ষক, স্টুডেন্ট ক্যাবিনেট/ কাউন্সিল মেম্বারস, ক্লাস ক্যাপ্টেনরা এ শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। শুধু বিদ্যালয় নয়; মাদ্রাসা, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী, স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরাও এ কার্যক্রমের আওতাধীন।
রয়েছে একটি হেল্পলাইনও। যেখানে কল করে কিশোর-কিশোরীরা বিনামূল্যে তাদের সমস্যার সমাধান পান।
রংপুর-নীলফামারির স্কুলগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, কিশোরীদের চোখে-মুখে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি। মাসিকসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষক ও সহপাঠীদের সাথে কথা বলছেন অকপটে।
নীলফামারির ডোমার উপজেলার পাঙ্গা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহনাজ জানান, স্কুলের অ্যাডোলেসেন্ট কর্নারে রুটিন অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্রেণির কিশোরীরা আসে। শিক্ষার্থীরা সেখানে সব ধরনের সহায়তা পেয়ে থাকে। স্কুলে এসে কোনো শিক্ষার্থীর মাসিক হলে তারা এখানে এসে নতুন প্যাড নিতে পারে। বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক খেলাধুলা, ভিডিও এবং চার্টের মাধ্যমে বয়ঃসন্ধিকালীন শিক্ষা দেয়া হয় তাদের। মাসিক হলে কী কী করতে হবে কোন কোন নিয়ম মেনে চলতে হবে সে বিষয়েও শেখানো হয়।
উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী তকির বলেন, ‘এখানে এসে আমরা ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের শারীরিক-মানসিক ও আচরণগত যে পরিবর্তন হয় সেগুলো সম্পর্কে জানতে পারি। প্রতি বৃহস্পতি ও রোববার এখানে আসি আমরা। বাল্যবিবাহ রোধে কী কী করণীয় সেসব শিখতে পারি। বাল্যবিয়ের নেতিবাচক ফলাফল সম্পর্কে জানতে পারি। আবার ছেলেদের স্বপ্নদোষ এটা যে ভয়ের কিছু না সেই শিক্ষা পাই।’
ডোমার উপজেলার পাঙ্গা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তরনী কান্ত রায় বিজনেস পোস্ট’কে বলেন, ‘ছাত্রীদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন, জেন্ডার সমতা ও নারীর প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের বিষয়ে স্কুলের অ্যাডোলেসেন্ট কর্নারে শিক্ষা দেয়া হয়। তারা যেনো আশপাশ থেকে কোনো ভুল শিক্ষা না পায় সে বিষয়ে সচেতন আমরা। নিজেদের কৈশোরে আমরা জানতাম না বয়ঃসন্ধিকাল কী। এ সময়ে কীভাবে চলতে হয় সে বিষয়ে কোনো ধারনা ছিলো না। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন স্কুলে এসে এ বিষয়ে সঠিক শিক্ষাটা পাচ্ছে। তারা জানে কীভাবে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে হবে। কী করলে স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপন করা যাবে। এখান থেকে যে শিক্ষাগুলো তারা পাচ্ছে সেগুলো তাদের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে কাজে লাগাচ্ছে।’
এবার দেখা যাক কী অবস্থা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোর
নীলফামারীর ডোমার উপজেলার পাঙ্গা মটুকপুর পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে অ্যাডোলেসেন্ট ক্লাবের মোট সদস্য ১৭ জন। ৭ থেকে ৮টি স্কুলের শিক্ষার্থীরা সেখানকার সদস্য। কৈশরকালীন সমস্যা নিয়ে ছেলে-মেয়েরা আগে কথা বলতে কুণ্ঠাবোধ করলেও; সেখানে দ্বিধাহীনভাবে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন তারা। বাল্যবিয়ে বা অন্যান্য কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরাও সেবা নিতে আসছেন সেখানে।
এ কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে ডিগ্রির শিক্ষার্থীরাও। তেমনই একজন জান্নাত। ডোমার মহিলা কলেজের এ শিক্ষার্থী জানান, বয়ঃসন্ধিকালে বিভিন্ন ভয়-ভীতি কাজ করে কিন্তু এখানে আসার মাধ্যমে সব ধরনের ভীতিকে জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। শুধু নিজেই নয় এখান থেকে শিখে নিজের ছোট ভাই-বোন ও প্রতিবেশীদেরও বিভিন্ন বিষয় শেখাচ্ছেন।
জান্নাতের ভাষায়; ‘প্রথম যখন মাসিক হয় ভয় পেয়েছিলাম খুব। আতঙ্কে দিন কাটতো। সেসময় বাইরে যেতাম না, এমনকি স্কুলেও না। ভয়ে থাকতাম বাইরে গেলে না জানি কী হবে! যেহেতু গ্রামে থাকি; গ্রামের মুরুব্বিরা বলতো এটা খাওয়া যাবে না, সেটা খাওয়া যাবে না। এ ধরনের বিভিন্ন অজ্ঞতা কাজ করতো। কিন্তু এখানে এসে বুঝতে পারি এগুলো আসলে শরীরবৃত্তিয় স্বাভাবিক ক্রিয়া। এ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই।’
পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা আনোয়ারা বেগম বিজনেস পোস্টকে বলেন, ‘এখানে জেন্ডার, জেন্ডার বৈষম্য ও সমতা, শ্রম বিভাজন বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হয়। বিএমআই ক্যালকুলেশন করে নিজেদের কী পরিমাণ পুষ্টি প্রয়োজন, কীভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে সে বিষয়ে শেখানো হয়। বিনামূল্যে স্যানিটারি প্যাড, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, আয়রণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়। এখানে এসে শিক্ষার্থীরা বই পড়তে পারে। এখানে ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ছেলেদের এবং ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত চলে মেয়েদের সেশন।’
আমাদের সমাজে বয়ঃসন্ধিকালীন যে বিভিন্ন ট্যাবু রয়েছে সেগুলো ভাঙতে অ্যাডোলেসেন্ট ক্লাব ও কর্নারের কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ রমিজ আলম বিজনেস পোস্টকে বলেন, ‘কিশোর-কিশোরীরা ভবিষ্যতের কাণ্ডারি। তাদের মধ্যে কৈশরকালীন শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে লোকলজ্জার যে ভয় সেটা দূর করতে না পারলে ভবিষ্যতে অনেক ধরনের রোগ-বালাইয়ের শিকার হবে তারা। ক্লিনিক্যাল দিক থেকে পরিণত বয়সেও যার ভোগান্তিটা থেকে যায়। সে কারণে এ বিষয়ে অনেক সচেতন আমরা।’
তিনি আরও বলেন, সঠিক জীবনাচারণের জন্য যেসব পরামর্শ প্রয়োজন কিশোর-কিশোরীরা এখান থেকে সেই শিক্ষাটা পায়। সব জায়গায় এটি দৃশ্যমান না হলেও কাজ হচ্ছে।
প্রতি মাসে কতজন নীলফামারি ও রংপুরের অ্যাডোলেসেন্ট ক্লাবগুলোয় আসছে সে বিষয়ক তথ্য লিপিবদ্ধ থাকছে রেজিস্ট্রার খাতায়। সেখানে দেখা যায় প্রতি মাসেই বাড়ছে কিশোর-কিশোরীদের সেবা নিতে আসার প্রবণতা।
দেশের প্রতিটি স্কুলে বয়ঃসন্ধিকালীন এ শিক্ষা কর্নার বাধ্যতামূলকভাবে থাকা দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তরুণ বয়সে নিরাপদ জীবন পেতে বয়ঃসন্ধিকালীন শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো: ইমরান হোসেন ভূইয়া বিজনেস পোস্ট’কে বলেন,
“উন্নত দেশগুলোতে পরিবারের পাশাপাশি গণযোগাযোগ মাধ্যম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বয়ঃসন্ধিকালীন শিক্ষা ও সচেতনতা বিষয়ে নানামুখী কার্মসূচী গ্রহণ করতে দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন বিষয়ে সচেতনতার অভাব, এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক নানা রক্ষণশীলতার কারণে পরিবারগুলো সাধারণত বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করতে থাকা শিশুদের যথাযথ দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই, বিশেষ করে বিগত দশক থেকে, বেসরকারি ও অলাভজনক অনেক প্রতিষ্ঠানই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ-এর প্রস্তুতকৃত নির্দেশনা অনুযায়ী বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সীমিত পরিসরে সেবা প্রদান করছে। একই সময়ে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সরকারি দিকনির্দেশনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বয়ঃসন্ধিকালীন শিক্ষা ও সেবা প্রদানের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে নানা পর্যায়ে।’
‘২০২১ সাল থেকে প্রথমবারের মতো দেশব্যাপী মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বয়ঃসন্ধিকালীন শিক্ষা ও সেবা প্রদানের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। ফলশ্রুতিতে বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে নিজের শারীরিক পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে সচেতন হবার পাশাপাশি সহপাঠীদের পরিবর্তনগুলো সম্পর্কেও শ্রদ্ধাশীল হবার শিক্ষা স্কুল থেকেই পাবে শিক্ষার্থীরা।’
সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে বয়ঃসন্ধিকালীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার এ উদ্যোগ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আত্মবিশ্বাসী ও লিঙ্গবৈষম্যহীন এক প্রজন্ম গড়ে তুলবে বলে মন্তব্য করেন এ বিশেষজ্ঞ।