প্রচ্ছদ ›› জাতীয়

লোডশেডিং: কমছে ঘুম, বাড়ছে অসুখ

আফরিন আপ্পি
২০ অক্টোবর ২০২২ ২১:২২:০০ | আপডেট: ২ years আগে
লোডশেডিং: কমছে ঘুম, বাড়ছে অসুখ
সংগৃহীত

সারাদিন অফিসের হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে বাসায় ফেরেন আয়েশা। এরপর সংসারের সব কাজ সেরে ক্লান্ত শরীরে ঘুমোতে যান বিছানায়। কিন্তু বিধিবাম! সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় বিদ্যুৎ। তীব্র গরমে এপাশ ওপাশ করে রাত পার হয় তার। ভ্যাপসা গরমে ঘুম যেনো কল্পরাজ্যের বাসিন্দা।

এ গল্প শুধু আয়েশার নয়। প্রতি ঘরে একই চিত্র। লোডশেডিংয়ের কারণে গরমে অতিষ্ঠ মানুষ। হাঁসফাঁস জনজীবন। প্রচণ্ড গরম আর ঘনঘন লোডশেডিং এখন রাতের ঘুমের বড় বাধা। ঘুমোতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশু,বয়ো-বৃদ্ধসহ সকলে। প্রতিটি ঘরেই এখন লোডশেডিংয়ের সাথে সর্দি-জ্বরের হানা। গরমে শরীরের ঘাম শুকিয়ে লেগে যাচ্ছে ঠাণ্ডা। আবার এই গরম আর এই ঠাণ্ডার ফলে বাড়ছে সর্দি, জ্বর, কাশি ও ডায়রিয়া।

রাজধানীসহ সারাদেশে বিদ্যুৎ থাকে না প্রায় পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। স্থানভেদে লোডশেডিং-এর মাত্রা আরও বেশি। গত ৪ অক্টোবর দেশের পূর্বাঞ্চলীয় জাতীয় গ্রিড ফেল করার পর আট ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও পরদিন থেকে বেড়ে যায় লোডশেডিংয়ের মাত্রা। সারাদেশে বিদ্যুতের এই যাওয়া-আসা এখন নৈমিত্তিক।

তবে চিকিৎসকরা বলছেন; লোডশেডিংয়ের ফলে রাতের কম ঘুম ডেকে আনছে বিপদ। বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

এ বিষয়ে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এইচ এম জহিরুল ইসলাম বিজনেস পোস্ট-কে বলেন, ‘রাত হলো বিশ্রামের সময়। সেসময় ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ায় মানুষের ঘুম পরিপূর্ণ হচ্ছে না। আর এই ঘুমের ঘাটতি থেকে শরীরে নানা রোগ বাসা বাঁধছে। এছাড়াও বর্তমান সময়ে বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক যারা আছেন তাদের ঠাণ্ডা-জ্বরের প্রবণতা বাড়ছে। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। রাতে ঘুম কম হলে নষ্ট হতে পারে শরীরের হরমোনের ভারসাম্য। এছাড়া হার্টের সমস্যা হতে পারে। দীর্ঘদিন রাতে না ঘুমানো বা কম ঘুমানোর ফলে শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।’

এ বিষয়ে শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোলজী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ মোঃ ইবরাহিম খলিল বিজনেস পোস্ট-কে বলেন, ‘পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব ডেকে আনতে পারে নানা অসুখ। একইসঙ্গে শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যেও ক্ষতিকর হয়ে ওঠতে পারে।’

পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী দুই ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে বলেও উল্লেখ করেন এ চিকিৎসক।

তিনি বলেন, ‘পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে দৈনন্দিন জীবনে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। দেখা দিতে পারে সাময়িকভাবে ভুলে যাওয়ার মতো সমস্যা। এর সঙ্গে যোগ হতে পারে মনোযোগহীনতার মতো বিষয়। একইসঙ্গে বাড়িয়ে তোলে মানসিক অবসাদও। অনিদ্রার কারণে কমে যেতে পারে কর্মক্ষমতাও। যার প্রভাব দেখা দিতে পারে উৎপাদনশীলতায়।’

দীর্ঘমেয়াদী পরিণতির বিষয়ে এ চিকিৎসক বলেন, ‘ঘুমের অভাবে নানা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এছাড়াও হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।’

পর্যাপ্ত ঘুম শারীরিক সমস্যার অবসান ঘটায় জানিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, ‘পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে অনেক সময় প্রাথমিকভাবে কোনো সমস্যা দেখা না দিলেও পরবর্তীকালে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।’

অক্টোবর নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় কথা থাকলেও; এখন সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হচ্ছে নভেম্বরেও কাটবে না বিপর্যয়।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘গ্যাস আনতে না পারায় নভেম্বরের আগে লোডশেডিং পরিস্থিতি উন্নতির আশা নেই। আমরা চেয়েছিলাম অক্টোবর থেকে কোনও লোডশেডিংই থাকবে না। কিন্তু সেটা আমরা করতে পারলাম না। কারণ আমরা গ্যাস আনতে পারিনি। সমস্যাটা সাময়িক হতে পারে। তবে আমি মনে করি, বললেই এটা সাময়িক হচ্ছে না। কারণ বিশ্ব পরিস্থিতি অন্যরকম।’

নভেম্বর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অক্টোবর থেকে ভালো পরিস্থিতি হয়ে যাবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু শিল্পে চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই আমরা বিদ্যুতে গ্যাস ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছি। আশা করছি, সামনের মাস থেকে আরেকটু ভালো হবে।’

সরকারের নির্দিষ্ট শিডিউল অনুযায়ী লোডশেডিং হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। গত ১৯ জুলাই এলাকাভিত্তিক এক ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের তালিকা তৈরি করে সরকার। এর কিছুদিন যেতে না যেতেই বলা হয় দুই ঘণ্টার কথা। তবে আদতে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ এর থেকে বহুগুণ বেশি। শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।

বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত মাহমুদ ফাহাদ বলেন, ‘সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সারাদিনে ১ ঘণ্টা বিদ্যুৎ যাওয়ার কথা ছিলো। এখন রাত বারোটার পরও যায়। রাতে ঘুমানোর সময় কারেন্ট থাকে না। যা খুবই কষ্টদায়ক।’

রাজধানীর রামপুরার গৃহিণী মাইমুনা বলেন, ‘লোডশেডিংয়ের কারণে তিন বাচ্চা নিয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে আছি। রাতে কারেন্ট থাকে না। ছোট বাচ্চার বয়স মাত্র ৭ বছর। সারারাত তাকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে হয়। বাতাস একটু বন্ধ হলেই উঠে বসে থাকে। সারদিন সেভাবে কারেন্ট না থাকায় চার্জার ফ্যানেও চার্জ দিতে পারি না। এ কারণে দেখা য়ায় রাতে একেবারেই ঘুম হচ্ছে না।’

ধানমন্ডির বাসিন্দা জারিফ বলেন, ‘লোডশেডিংয়ের কারণে সকালে অফিসে পৌঁছতে প্রায়ই দেরি হয়। রাতে বিদ্যুৎ না থাকায় ঠিকমতো ঘুমোতে পারি না। সেজন্য সকালেও ঠিকমতো উঠতে পারি না। এর ফলে অনেক শ্রমঘণ্টার অপচয় হয়।’

আহসান খান বলেন, ‘দিনের বেলা অফিসে থাকি। অফিসে জেনারেটর থাকায় সেভাবে টের পাই না। কিন্তু রাতে বাসায় ফিরে যখন দেখি ইলেকট্রিসিটি নেই তখন খুব কষ্ট হয়। রাতে ঘুমোতে না পারলে পরের দিনটা খুবই খারাপ কাটে। সারাক্ষণ মাথা ব্যথা করে। বমি ভাব হয়।’

দিনের লোডশেডিং এর সাথে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু মধ্যরাতের এই বিদ্যুৎ বিভ্রাট আর সহ্য হয় না বলে মন্তব্য করেন ব্যাংকার ফেরদৌস আরা।

তিনি বলেন, ‘প্রতিরাতের একই শিডিউল। রাত সাড়ে ১২টার দিকে বিদ্যুৎ চলে যায়। পরে দেড়টার দিকে আসে। তারপর আবার দুইটার দিকে চলে যায়। আসে ভোর চারটা-পাঁচটার দিকে। দিনশেষে বাসায় ফিরে একটু ঘুমোতেও পারি না।’

এদিকে জুলাইয়ের শুরুর দিকে সরকারের পক্ষ থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি ও সরবরাহ ব্যহতের কথা জানানো হয়। তাই নিজস্ব জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের কথা বলা হয়।

তবে সেপ্টেম্বর থেকে উন্নতি হতে থাকে পরিস্থিতির। কমতে থাকে লোডশেডিং। এর মধ্যে ৪ অক্টোবর বিদ্যুতের পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিড অচল হয়ে পড়লে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেটসহ ৩০টির বেশি জেলা ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। আর এর পর থেকেই বাড়তে থাকে লোডশেডিং।

কবে নাগাদ এ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে সে বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মো: মাহবুবুর রহমানের সাথে মুঠোফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েরসাইটে এ বিষয়ে তার একটি বার্তা পাওয়া যায়।

সেখানে বলা হয়েছে; ‘এরকম একটি পরিস্থিতির জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। আমরা এখন এক বৈশ্বিক অস্থিরতার সময় অতিক্রম করছি। করোনা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ আরো কিছু বৈশ্বিক বিষয়ের অভিঘাত আমাদেরকে স্পর্শ করেছে। মাত্র কিছুদিন আগে আমরা যে শতভাগ বিদ্যুতায়নের সাফল্য উদযাপন করলাম, বৈশ্বিক অভিঘাতে তা কিছুটা হলেও ম্লান হয়েছে। কারণ, গ্যাসের অপ্রতুলতা এবং তরল জ্বালানির উচ্চ মূল্যের কারণে ব্যয় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে আমাদের সীমিত এবং পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ে যেতে হয়েছে। আমরা আশা করছি শীঘ্রই আমরা এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো।’