দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সেখানে পর্যটকদের আসা-যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে ফি আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার। এক্ষেত্রে দ্বীপে ভ্রমণের জন্য ধারণক্ষমতা অনুযায়ী পর্যটকের সংখ্যা নিশ্চিত করা হবে এবং সব পর্যটকদের অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের কড়াকারি আরোপ করবে সরকার।
‘সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটন নির্দেশিকা,২০২৩’ এ সব সহ ৩৫ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। ২৩ মে মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়।
অপরিকল্পিত স্থাপনা ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করার প্রেক্ষিতে জারি করা প্রজ্ঞাপনে পর্যটন ও পরিবহন ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বলা হয়; সব পর্যটককে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমণের জন্য অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। দ্বীপে অবতরণের জন্য পর্যটকদের ফি নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিদিন দ্বীপের প্রকৃত ধারণক্ষমতা অনুযায়ী পর্যটকের সংখ্যা নিশ্চিত করতে হবে।
আরও বলা হয়, সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ রক্ষাকল্পে পর্যটক ও স্থানীয়দের জন্য অনুসরণীয় ও বর্জনীয় কার্যাবলির তালিকা সম্বলিত নোটিশ, বিলবোর্ড, প্রচারপত্র প্রকাশ করতে হবে। দ্বীপের চাহিদা বিবেচনা ও বাস্তবতায় মৎস্যজীবী, মৎস্য শিকারি ও ব্যবসায়ীদের জন্য দ্বীপে একটি পরিবেশবান্ধব মৎস্য অবতরণ ও বাজারজাতকরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। মৎস্য শিকারের জন্য নির্ধারিত নৌযানে যাত্রী বা পর্যটক পরিবহন করা যাবে না। পর্যটক পরিবহন করলে দ্বীপে মৎস্য শিকার বা ব্যবসার অনুমতি বাতিল করা হবে।
পর্যটকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগটি আসে ২০২০ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায়। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও বিপুলসংখ্যক পর্যটকের যাতায়াতকে দ্বীপটির অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওই সভায় সেন্টমার্টিনে পাঁচ বছরের জন্য পর্যটন নিষিদ্ধের সুপারিশও করা হয়েছিল।
তখন জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পর্যটক নিয়ন্ত্রণে দ্বীপটিতে দিনে ১ হাজার ২৫০ জনের বেশি পর্যটক যেতে পারবেন না এমন উদ্যোগ নেয় সরকার। এর পরে সেন্টমার্টিনে দৈনিক ৩০০০ পর্যটকের ভ্রমণ সুবিধা দাবি করে ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক)। স্থানীয় হিসাবে ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ভরা মৌসুমে দিনে ৫০০০ থেকে ৮০০০ পর্যটক দ্বীপটিতে যান।
সেন্টমার্টিন নিয়ে আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হতে পারে। দ্বীপটিতে প্রবাল ছাড়াও বিশ্বজুড়ে বিলুপ্তপ্রায় জলপাই রঙের কাছিম, চার প্রজাতির ডলফিন, বিপন্ন প্রজাতির পাখিসহ নানা ধরনের বন্য প্রাণীর বাস।
দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশবাদীরা বলছেন, দ্বীপটি পর্যটকদের অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রমের কারণে মারাত্মক ধ্বংসের মুখে রয়েছে। দেশের একমাত্র ওই প্রবাল দ্বীপের জীববৈচিত্র্য এবং বনভূমি মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে। ফলে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকদের যাতায়াত সাময়িক নিষিদ্ধ করা উচিত।
সম্প্রতি জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বন অধিদপ্তর মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়ার কোর এলাকা চিহ্নিত করবে এবং নির্ধারিত ল্যান্ডিং এলাকা ছাড়া কোর এলাকায় জাহাজ যেন না যায় তা নিশ্চিত করবে। দ্বীপের পর্যটন সংক্রান্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, নির্ধারিত নৌযানের অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন বন্ধ ও পরিবেশবান্ধব অবস্থা নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে। স্থানীয় যুবকদের ট্যুরিস্ট গাইড হিসাবে প্রশিক্ষিত করে টেকসই পরিবেশবান্ধব পর্যটন নিশ্চিত করতে হবে। সমুদ্রে শৈবাল ও কোরাল পুনর্জন্ম নির্বিঘ্ন রাখতে পর্যটকবাহী জাহাজ তীর থেকে ২০০ মিটার দূরে জেটিতে নোঙর নিশ্চিত করার নতুন এ নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
নির্দেশনায় অবকাঠামো ও স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে বলা হয়, সেন্টমার্টিন দ্বীপে স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে কক্সবাজার উন্নয়ন কতৃপক্ষ আইন অনুসরণ করতে হবে। একই সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তি নিতে হবে। সরকারি সংস্থার স্থাপনা, স্টল হাউজ, ডরমিটরি, হোস্টেল, সরকারি কাজ ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা যাবে না।
ভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বলা হয়, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভূমি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কারিগরি ও প্রাসঙ্গিক সহায়তা নিয়ে ভূমি জোনিং ও ম্যাপ তৈরি করবে। একই সঙ্গে অবকাঠামো নির্মাণ বা পুননির্মাণের বিসয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করবে।
দ্বীপের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বলা হয়, দ্বীপে পরিবেশসম্মত সেকেন্ডারি ডাম্পিং স্টেশন স্থাপন করা হবে। সম্পূর্ণ দ্বীপ সার্বক্ষণিক পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন রাখতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্থানীয়দের নিয়ে সেচ্ছাসেবক দল গঠন করা হবে। দ্বীপের সব প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় নিজ নিজ বর্জ্য সেকেন্ডারি ডাম্পিং স্টেশনে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের বর্জ্য পরিবেশসম্মত ব্যাগে ভর্তি করে বাড়ির সামনে রাখতে হবে। কক্সবাজার উন্নয়ন কতৃপক্ষ ও সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ বর্জ্য সংগ্রহ করে সেকেন্ডারি ডাম্পিং স্টেশনে ডাম্প করবে। সেকেন্ডারি ডাম্পিং হতে সব ময়লা ও বর্জ্য দ্বীপের বাইরে পরিবেশবান্ধবভাবে মূল ভূখণ্ডে স্থানান্তর করা হবে। দ্বীপে ও সমুদ্রবক্ষে বর্জ্য ও পয়ঃবর্জ্য অনুমতি ছাড়া নিঃসরণ করা যাবে না। নৌযান বা জাহাজ বর্জ্য নিঃসরণ করলে রুট পারমিট বাতিলসহ জাহাজ চলাচল বন্ধ করা হবে।
দ্বীপে চলাচলকারী সব জলযান এবং পলিথিন ও প্লাস্টিক পাত্রে খাবার, চিপস এবং প্লাস্টিক বোতলে পানি ও পানীয়, পলিথিন প্লাস্টিকজাত মাল্টি-লেয়ার মোড়কসহ পণ্য, পলিথিন ব্যাগ, সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকজাত সব পণ্য, সিগারেট ফিল্টার ও কটন বার্ডস উৎপাদন, সংরক্ষণ, মজুদ, পরিবহন, ক্রয়, বিক্রয় ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়ে বলা হয়, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের ফলে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ ও পরিবেশগত ক্ষতি এবং অর্থনীতিতে আবদানের আর্থিক মূল্য নিরূপণ করতে হবে। সেন্টমার্টিন দ্বীপে মোটরযান ও যন্ত্রচালিত যানবাহন- মোটরসাইকেল, ভটভটি, নছিমন, করিমন এবং ব্যাটারিচালিত যানবাহন নিষিদ্ধকরা হয়েছে। রিক্সা, ভ্যান, ও সাইকেল কেবল সড়কে ব্যবহার করা যাবে। দ্বীপে আলো ও আগুন জ্বালানো, ফানুস ও আতশবাজি, শব্দদূষণকারী মাইক, সাউন্ডবক্স ও ডিভাইস ব্যবহার করা যাবে না। জেনারেটরে শব্দশোষক যন্ত্র সংযোজন করে বদ্ধ স্থানে স্থাপন করতে হবে।
সৈকত এলাকায় কেয়াবন ও ঝোপঝাড় ধ্বংস, অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, নৌকার নোঙর ফেলে প্রবাল ধ্বংস, প্রবাল ও শৈবালযুক্ত পাথরের উপর হাঁটাচলা, জ্বালানির জন্য কেয়াবন, প্যারাবন ও গাছপালা কাটা এবং জোয়ারভাটা অঞ্চল ও দ্বীপের অভ্যন্তর, সৈকত ও সমুদ্র এলাকা থেকে পাথর উত্তোলন করা যাবে না। সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, তারা মাছ, রাজকাঁকড়া, সামুদ্রিক ঘাস, সামুদ্রিক শৈবাল এবং কেয়া ফল সংগ্রহ ও ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না। জাহাজ থেকে পাখিকে চিপস বা অন্য কোন খাবার পরিবেশন করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুয়ায়ী, সেন্টমার্টিন দ্বীপে শিক্ষা সফর, দলবন্ধ ভ্রমণ, সেমিনার, কর্মশালা, রিপোটিং, শুটিং, সেচ্ছসেবী প্রতিষ্ঠান পরিচালিত সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম, কনফারেন্স, আউটরিচ কার্যক্রম, সী বিচ স্পোর্টস কার্যক্রম পরিচালনা করতে আগে অনুমতি নিতে হবে। এছাড়া হেলিকপ্টার, সী প্লেন, ড্রোন, স্কুবা ডাইভিং, মেরিন প্যারাগ্লাইডিং চালাতে অনুমতি লাগবে। এই দ্বীপ সংরক্ষণের জন্য এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আর নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, কক্সবাজার উন্নয়ন কতৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর, বন অধিদপ্তর, নৌ পরিবহন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট, জেলা প্রশাসন কক্সবাজার, উপজেলা প্রশাসন টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ। বাস্তবায়ন সহযোগী হিসাবে আরও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার বিভাগ, বাংলাদেশ পুলিশ ও ট্যুরিস্ট পুলিশ, কোস্ট গার্ড, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর।