প্রচ্ছদ ›› জাতীয়

৩০০ টাকা ছুঁইছুঁই ব্রয়লার মুরগি

নিজস্ব প্রতিবেদক
২২ মার্চ ২০২৩ ১০:২৮:১৯ | আপডেট: ২ years আগে
৩০০ টাকা ছুঁইছুঁই ব্রয়লার মুরগি

খাবারসহ অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধির পরও এক কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ করপোরেট প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা। আর প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে খরচ পড়ে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। অথচ বাজারে এর দাম ৩০০ টাকা ছুঁইছুঁই। রোজার ঠিক আগ মুহূর্তে এমন দাম দেখে অনেকেরই ‘চক্ষু চড়ক গাছ’ হয়ে গেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, গরুর পর এবার মুরগির মাংসকেও বিদায় জানাতে বাধ্য হবেন অনেক ক্রেতা।

রাজধানীর রায়েরবাজারে মুরগি কিনতে এসে বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, ‘ব্রয়লারের কেজি ২৭০-২৮০ টাকা হবে কখনো কল্পনাও করিনি। সুযোগ বুঝে রোজা শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে এক লাফে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। বাজারে যা খুশি চলছে। দেখার যেন কেউ নেই। দ্রব্যমূল্যের এ পাগলা দৌড় কে থামাবে। এত দামে মুরগি কেনা সম্ভব নয়। এখন গরুর মতো মুরগি খাওয়াও ছাড়তে হবে।’

রাজধানীর মালিবাগ বাজারে দেখা গেছে, ব্রয়লার বিক্রি হচ্ছে ২৬৫ থেকে ২৭০ টাকা পর্যন্ত। মহাখালী, সেগুনবাগিচাসহ কদমতলী এলাকার কয়েকটি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৭৫ টাকায়। কোথাও কোথাও ২৮০ টাকাও নেওয়া হচ্ছে।

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, কাপ্তানবাজারসহ রাজধানীর পাইকারি বাজারগুলোয় দুই দিনের ব্যবধানে কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা দাম বেড়েছে। পাইকাররা বলছেন, সরবরাহ কমেছে। তাই বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে তাদের। খামার পর্যায়েও দাম বাড়ছে বলে জানান খামারিরা।

অথচ গত রোববার ভোক্তা অধিদপ্তর জানিয়েছে, মুরগির খাবারসহ অন্যান্য সব ব্যয় বৃদ্ধির পরও এক কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন ব্যয় করপোরেট প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা এবং প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। এ মুরগির বিক্রয়মূল্য সর্বোচ্চ ২০০ টাকা হতে পারে। বাজারে মুরগির দাম কত হওয়া উচিত, তা আরও যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে অনুরোধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও পোলট্রিশিল্পের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে মুরগির দাম নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি নিয়ন্ত্রণে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশও করেছে সংস্থাটি।

এদিকে প্রান্তিক খামারিরা বলছেন, পোল্ট্রি খাতে প্রতিটি পর্যায়ে অনিয়মের কারণে বাজারে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অব্যবস্থাপনা ও নজরদারির ঘাটতির সুযোগ নিয়ে কয়েকটি চক্র অল্প সময়ে বিপুল মুনাফার চেষ্টা করছে। এর আগেও একবার মুরগি ও ডিমের বাজারে এমনটা হয়েছে। এবার রমজান মাস শুরুকে কেন্দ্র করে আবারও তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, একদিনের বাচ্চার দাম বাড়তে বাড়তে ৬৫ টাকায় পৌঁছেছে। বাড়তি এ দামেও বাচ্চা পাওয়া যাচ্ছে না।

চট্টগ্রামের পটিয়া থানার প্রান্তিক খামারি মো. শহীদুল আলম ও জয়পুরহাটের খামারি মিজবাহ-উল-হক জানান, বাচ্চা ও মুরগির দাম মুঠোফোনের এসএমএসের মাধ্যমে হুটহাট বাড়ে-কমে। গতকালও এসএমএসে একদিনের বাচ্চার দর ৬২ থেকে ৬৭ টাকা জানানো হয়েছে। এ দামেও বাচ্চা মিলছে না। সিন্ডিকেটের বাইরের কারও বাচ্চা পেতে প্রতি পিসে ১০ থেকে ২০ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। যারা করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কন্ট্রাক্ট ফার্মিয়ে যুক্ত রয়েছেন, তারা কম দামে বাচ্চা পাচ্ছেন। অপরদিকে ভোক্তা অধিদপ্তরের সঙ্গে বৈঠকের পরই অজানা কারণে ফিডের (মুরগির খাবার) দাম হঠাৎ বাড়িয়ে দিয়েছে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।

বর্তমানে ব্রয়লারের একদিনের বাচ্চার দাম ৬২ থেকে ৬৭ টাকা। যদিও খামারিরা বলছেন, বাচ্চা সংকট দেখিয়ে ডিলাররা দাম আরও বেশি রাখছেন। অথচ জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহেও বাচ্চার দাম ছিল মাত্র ৯ টাকা। ১৫ তারিখে দাম বেড়ে ১৫ থেকে ১৮ টাকা হয়। এরপর ২৫ তারিখে ৩০ টাকা, ২৬ তারিখে ৩৬ টাকা, ৩০ তারিখে হয় ৪০ টাকা। ২ ফেব্রুয়ারি ৩৯ থেকে ৪২ এবং ৫ ফেব্রুয়ারি ৫৩ থেকে ৫৫ টাকায় ওঠে। মার্চে আরও বাড়ে। অর্থাৎ প্রায় আড়াই মাসে দাম ৭ গুণেরও বেশি বেড়েছে। খামারিরা বলছেন, একটি বাচ্চার দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত হলে সেটা স্বাভাবিক।

বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, একদিনের বাচ্চার সম্পূর্ণ বাজার বড় করপোরেট কোম্পানিগুলোর হাতে। পাশাপাশি কন্ট্রাক্ট ফার্মিয়ের নামে তারা সিন্ডিকেট গড়ে তুলছেন। গায়েবি এসএমএসে (মুঠোফোন বার্তা) হুটহাট বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সিন্ডিকেটের বাইরের খামারিরা বাচ্চা পাচ্ছেন না। পেলেও অতিরিক্ত দাম রাখা হচ্ছে। সব দিক থেকেই করপোরেট কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত মুনাফা করছে।

পোল্ট্রি খাতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে কারসাজিকারী চক্র ১৮০ কোটি টাকা লোপাট করেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এবারের হিসাব আরও বড় হবে। রোজা ঘিরে আবারও একটি চক্র কারসাজি করছে। এর আগেও ডিম নিয়ে বড় কোম্পানির কারসাজির তথ্য উঠে এলে সরকারি সংস্থা মামলাও করেছে। কিন্তু তার সুরাহা হয়নি। আমরা বহুবার এ তথ্য তুলে ধরছি। অথচ কারও যেন টনক নড়ছে না। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও যেন চোখ বুজে আছে। ২০১০ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ১ মাসের সময় নিয়েছিল পোল্ট্রি ফিড, মুরগির বাচ্চা, ডিম ও মুরগির ন্যায্যমূল্য নির্ধারণের কৌশলপত্র তৈরির জন্য। কিন্তু তা এখনো হয়নি।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কারসাজি করে বড় লোকসানে ফেলে ছোট খামারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। যেগুলো অবশিষ্ট রয়েছে, সেগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বাজার দখল করে নিয়েছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। এখন তারা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। সিন্ডিকেটের হাতে বাজার চলে গেলে এমনটাই হয়।

তিনি আরও বলেন, ডিম নিয়ে কারসাজির সময় আমরা দেখেছিলাম আমদানির ঘোষণায় দাম রাতারাতি কমে গিয়েছিল। এবার ডলার সংকটের কারণে মুরগি আমদানির সিদ্ধান্ত হয়তো নেওয়া যাবে না। এ কারণেই হয়তো মুরগির বাজারে কারসাজি চলছে।

কারসাজিকারীরা বাজারে নানা অনিয়ম ও মনিটরিংয়ে ঘাটতির সুযোগ নিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ক্রয়-বিক্রয়ে রসিদ ব্যবহার হচ্ছে না। বাজারে হাত বদলের সংখ্যা কমাতে হবে। বারবার ব্যবসায়ী সমিতির নাম উঠে আসছে। ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমনটা হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।