প্রচ্ছদ ›› জাতীয়

অনিশ্চিত রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যৎ

কামরুল হাসান
২৫ ডিসেম্বর ২০২২ ১৪:১৬:০৩ | আপডেট: ২ years আগে
অনিশ্চিত রোহিঙ্গা শিশুদের ভবিষ্যৎ

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। এক বৃষ্টিমুখর দিনে ১২ বছর বয়সী নুর হোসেনের সাথে বালুখালী অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সেসময় নুর হোসেন তার দুঃখ-কষ্ট ও প্রত্যাশার বিষয়গুলো তুলে ধরেন

মংডু টাউনশিপে নিজের বাড়ি ছেড়ে আসায় দুঃখ পেয়েছে নুর হোসেন। তবে তিনি খুশিও। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি নিয়ে আর চিন্তিত হতে হয় না তাকে। পাশাপাশি নয়াপাড়া ক্যাম্পে তার বন্ধুরা যে শিক্ষা পাচ্ছেন তার সবটাই এখন তিনি পাবেন।

সাত ভাইবোনের মধ্যে ষষ্ঠ নুর মিয়ানমারের পাঠ্যক্রমের দ্বিতীয় গ্রেড শেষ করেছেন। সে তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক। মগ স্কুলে তাদের লেখাপড়ার অনুমতি না থাকায়, তিনি প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে দেন এবং ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) পরিচালিত মিয়ানমারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে একটি শিক্ষালয়ে ভর্তি হন।

শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন নুর হোসেন। পাঁচ বছর পর এই প্রতিবেদক নুরকে খুঁজে না পেলেও কথা হয় তার বয়সী আরও অনেকের সঙ্গে।

কৈশোর বা সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলেরা এখন ভিন্ন কথা বলছে। তাদের চোখে মুখে এখন আর শিক্ষক বা সাহায্যকর্মী হওয়ার স্বপ্ন নেই। তার পরিবর্তে সেখানে ভর করেছে একরাশ হতাশা।

তাদের একজন, মোহাম্মদ জসিম (ছদ্মনাম), বয়স ১৯। ক্যাম্প-৪ এর বাসিন্দা। জসিম তার বাবা এবং চার ভাইবোনের সাথে মিয়ানমারের বুথিডাং শহর থেকে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। আগামী বছর ফেব্রুয়ারির মধ্যে তার অষ্টম গ্রেড পড়া শেষ হবে।

জসিম বলেন: “আমি শিক্ষক হতে চাই এবং আমার সম্প্রদায়ের অন্যান্য শিশুদের শেখাতে চাই। কিন্তু আমরা কয়জন এ সুযোগ পাই?" প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন; ক্যাম্প ম্যানেজমেন্ট সম্প্রতি গ্রেড নাইন চালু করেছে এবং এখন আমরা আর একটু পড়াশোনা করতে পারবো কিন্তু- "এরপর কী?"

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং কক্সবাজার ক্যাম্পের বিরাজমান পরিস্থিতি

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে জান্তা সরকার রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা গ্রহণে বাধা দিয়ে আসছিলো। শিশুদের বেশিরভাগই ছিল বন্দী শিবিরে।

তবে নব্বইয়ের দশকের আগে পরিস্থিতি এমন ছিল না। ২০১৭ সালে অনেক বয়স্ক রোহিঙ্গা এই প্রতিবেদককে জানান যে; তারা মংডু বা বুথিডাং শহরের স্বীকৃত সরকারি স্কুলে মগদের সাথে গিয়েছেন।

বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যের চেয়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তারা শিক্ষার ভালো সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন।

ইন্টার-সেক্টরাল কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজি) শিক্ষাক্ষেত্র অনুসারে কিন্ডারগার্টেন, গ্রেড-১ এবং গ্রেড-২ শিশুদের জন্য এমসি স্কেল-আপ চলছে। মিয়ানমার কারিকুলাম (এমসি) পাঠ্যপুস্তকগুলি কেজি, গ্রেড-১, এবং গ্রেড-২ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুদ্রিত এবং বিতরণ করা হয়।

এছাড়া, এলসিএফএ (লার্নিং কমপিটেন্সি ফ্রেমওয়ার্ক এন্ড অ্যাপ্রোচ) থেকে এমসি-তে একটি স্বাভাবিক রূপান্তর ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য গ্রেড-১ এবং ২-এর জন্য প্রতিকারমূলক প্যাকেজগুলো সম্পূরক উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।

যারা বয়সে একটু বড় (১১ বছর এবং তার বেশি) তাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য এএলপি (অ্যাক্সিলারেটেড লার্নিং প্রোগ্রাম) দুটি প্যাকেজে (এএলপি-১ এবং এএলপি-২) তৈরি করা হয়। এছাড়া রোহিঙ্গা এবং হোস্ট উভয় সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষক উন্নয়ন কর্মসূচী নির্দিষ্ট বিষয়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

গ্রেড ৬, ৭, ৮ এবং ৯ এর জন্য মিয়ানমার পাঠ্যক্রমের পাইলট প্রকল্প চলছে। সেখানে ১০ হাজার ৯১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়ে ১ হাজার ৮০৩ জন।       

রোহিঙ্গা মানবিক সংকটের জন্য যৌথ পরিকল্পনার আওতায় প্রায় ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ শিশুকে শিক্ষার সুযোগ দিতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত তালিকাভুক্ত হয়েছে ৩ লাখ ৫৬ হাজার ১৬ জন।

৩৩টি ক্যাম্পে ৫ হাজার ৬২৮ টি কেন্দ্রে শেখার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪১৫টি শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে যেখানে প্রায় ৪ হাজার ৬৮৯ জন পুরুষ এবং ১ হাজার ৪৮২ জন নারী। রোহিঙ্গাদের সহায্যকর্মী রয়েছেন ৩ হাজার ৬৮৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৮৪৪ জন এবং নারী ২ হাজার ৮০৫ জন।

প্রতিটি ফ্যাসিলিটেটরে অন্তত দুইজন ফ্যাসিলিটেটর রয়েছে যেখানে রোহিঙ্গা ফ্যাসিলিটেটররা শিশুদেরকে রোহিঙ্গাদের মাতৃভাষা শেখায় এবং হোস্ট ফ্যাসিলিটেটররা শেখায় ইংরেজি ।

ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন

মোঃ ফেরদৌস আলম। যিনি ২০১৭ সালে কোডেকের কর্মকর্তা ছিলেন। বর্তমানে একটি এনজিওর হয়ে ক্যাম্পে সুরক্ষার কাজ করছেন। দ্য বিজনেস পোস্টকে তিনি বলেন, “প্রথমদিকে ৭ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের শিক্ষা গ্রহণে আরও বেশি আগ্রহী দেখা যেত। মিয়ানমারে তেমন সুযোগ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে আমরা তাদের মাঝে ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা দেখতে পাচ্ছি।

তিনি বলেন; তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও জীবিকার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে যদি খুব বেশি সময় লাগে, তাহলে সুযোগ-সুবিধা বা দক্ষতা অর্জন করে কী লাভ হবে?

কুতুপালং-এর একটি ক্যাম্পে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের প্রাক্তন এমপিসি লিড, সালমা সুলতানা বলেন; প্রশিক্ষণ শেষ করার পর তাদের দক্ষতা বিকাশের সুযোগ কম।

তিনি মনে করেন; এই প্রশিক্ষিত লোকদের এনজিও-র কাজে অন্তর্ভুক্ত করাসহ আরও কার্যক্রম শুরু করা দরকার যাতে তাদের দক্ষ করে তোলা যায় এবং তাদের বর্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট রাখা যায়। 

কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক তহবিলের বেশি প্রয়োজন তখন তহবিল কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে অক্সফামের কান্ট্রি ডিরেক্টর আশিস দামলে বলেন, কারণ যাই হোক না কেন, একটি ছোট ও অধিক জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ বছরের পর বছর ধরে যে দায়িত্ব পালন করছে তা বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের নেওয়া উচিত ছিলো।

১৪ ডিসেম্বর রাজধানীতে অক্সফাম বাংলাদেশ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে ইউনিসেফের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ এমা ব্রিঘাম মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম ব্যবহার করে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য একটি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার জন্য ধন্যবাদ জানান।

ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিজ (ভিএসও) বাংলাদেশের সাবেক প্রোগ্রাম ম্যানেজার সাইফুন্নাহার বলেন, বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ শরনার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী নয়; এটি ১ মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে হোস্টিং এবং মানবিক সহায়তা প্রদান করছে। আর তাই চাইলেও অনেক কিছুই করতে পারেনি বাংলাদেশ। হতাশা মোকাবেলার সর্বোত্তম সমাধান হল তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো মানে প্রত্যাবাসন বা তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানো যাতে এই মানুষগুলো তাদের স্বাভাবিক জীবনাচারণ ফিরে পায়। এজন্য বাংলাদেশকে শরণার্থী কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী হতে হবে বা অন্য সব বিকল্প পেতে তাদের শরণার্থী সংক্রান্ত আইনি কাঠামো সংশোধন করতে হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের (এমওডিএমআর) অধীনস্থ কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, বাস্তবতা বুঝতে পেরে ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা শিক্ষা ব্যবস্থায় নবম গ্রেড চালু করা হয়েছেে এবং শিক্ষাবিষয়ে যা যা করা সম্ভব সব করা হচ্ছে। 

সাইফুন্নাহারের সুরে সুর মিলিয়ে তিনি বলেন; রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বা তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে অন্য দেশে পাঠানোর বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে।

শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন; প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হলে রোহিঙ্গারা, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাবার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে এবং এর ফলে তারা পাচারকারীদের হাতে পড়ে যেতে পারে। সময়ের সাথে সাথে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।