প্রচ্ছদ ›› জাতীয়

কবে দক্ষ হবে পেট্রোবাংলা?

আশরাফুল ইসলাম রানা
৩০ নভেম্বর ২০২২ ১২:০৯:০৫ | আপডেট: ১ year আগে
কবে দক্ষ হবে পেট্রোবাংলা?

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) দিনাজপুরের পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (এমজিএমসিএল) কাছে ১.৩৯ বিলিয়ন টন কঠিন শিলার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে।

সেখানে একটি খনি থেকে উত্তোলন কাজ চলছে, সরকার এখন এমজিএমসিএলের অধীনে দ্বিতীয় খনি খোলার পরিকল্পনা করছে। এমজিএমসিএল পেট্রোবাংলার অধীনে পরিচালিত ১৩টি কোম্পানির মধ্যে একটি।

তবে নতুন খনির উন্নয়নে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা লাগবে এবং পেট্রোবাংলার কাছে তহবিল না থাকায় বেসরকারি খাতের কোনো ঠিকাদারকে প্রকল্পটি দেওয়ার কথা ভাবছে রাষ্ট্রায়ত্ত কর্পোরেশন। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তাদের কারিগরি অদক্ষতাও এর একটি বড় কারণ।

বিষয়টির তীব্র বিরোধিতা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন প্রকল্পটি বেসরকারি খাতে গেলে দেশের মানুষ রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।

উভয় খনি সম্পূর্ণরূপে বিদেশি ঠিকাদারদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং লাভের একটি বড় অংশ তাদের পকেটে যায়। সেজন্য বিশেষজ্ঞরা পেট্রোবাংলাকে-ই নতুন খনি তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন।

বিজনেস পোস্টের সাথে আলাপকালে পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন বলেন, কঠিন শিলার মোট অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৫ শতাংশই আমদানি করা হয়। “পেট্রোবাংলা এবং এমজিএমসিএল এখন পর্যন্ত মধ্যপাড়া খনি ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা দেখাতে পারেনি। নতুন খনি লাভজনক হতে পারে এই বিষয়টি বিবেচনা করে সরকারকে তার ব্যবস্থাপনার সাথে এই জাতীয় সম্পদ আহরণের বিষয়ে সর্বাধিক সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত।”

মধ্যপাড়ার ধাঁধা

মধ্যপাড়ায় দেশের একমাত্র গ্রানাইট খনিটি ১৯৭৪ সালে মাটির নিচে ১২৮-১৩৬ মিটার গভীরে আবিষ্কৃত হয়। পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী; প্রায় ১.২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় এই খনিতে মোট পাথরের মজুদ ২১.৬ মিলিয়ন টন এবং এর মধ্যে ১০.১৩ মিলিয়ন টন পুনরুদ্ধারযোগ্য।

১৯৯৪ সালে, পেট্রোবাংলা খনি উন্নয়ন এবং পাথর উত্তোলনের জন্য উত্তর কোরিয়ার কোরিয়া সাউথ-সাউথ সহযোগিতা কর্পোরেশনের সাথে চার বছরের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা এনএএম-এনএএম নামেও পরিচিত। খনিটি উন্নয়ন করে পেট্রোবাংলার কাছে হস্তান্তর করার কথা ছিল।

কিন্তু পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা প্রস্তুত না হওয়ায়, নামনাম আরও দুটি সম্পূরক চুক্তির মাধ্যমে ২০০৭ সাল পর্যন্ত খনি উন্নয়নে কাজ করে।

২০০৭ সালে নামনাম চলে যাওয়ার পর এমজিএমসিএল-এর দায়িত্ব নেয়। সেসময়ে, নামনাম এর ৬০ কর্মী এমজিএমসিএলের কর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন। ২০১২ ঘটনার শেষ অবধি, এমজিসিএল খনিটি পরিচালনা করে। তবে তারা মারাত্মক লোকসান এবং দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিল।

এমজিএমসিএলের একজন কর্মকর্তা, যিনি বর্তমানে অন্য একটি পেট্রোবাংলা কোম্পানির সেকেন্ডমেন্টে হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। বিজনেস পোস্টকে বলেন; এমজিএমসিএলের বেশিরভাগ কর্মকর্তারা কখনোই খনি উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে স্বাবলম্বী হতে চান না।

“ভূতাত্ত্বিক এবং খনির এমন অনেক কর্মকর্তারা আছেন যারা দক্ষ হওয়ার জন্য কোনো চেষ্টাই করেননি। তদুপরি, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা এমজিএমসিএল থেকে ভালোদের সরিয়ে দিয়েছে।”

খনি বিশেষজ্ঞ ও ভূতাত্ত্বিক অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, “এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে; দেশের দুটি খনি ঠিকাদারদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। কারণ এতদিন পরেও পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা খনি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।”

পেট্রোবাংলার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাও নিশ্চিত করেছেন; এমজিএমসিএলে কর্মরত বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তা অদক্ষ এবং খনি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাদের যথেষ্ট জ্ঞান নেই, যার ফলে গুনতে হচ্ছে লোকসান।

জিটিসি’তে প্রবেশ

অচলাবস্থা কাটাতে সরকার ২০১৩ সালে মধ্যপাড়া খনিটি জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) নামে একটি বেসরকারি কোম্পানিকে অর্পণ করে। ১,৪০০ কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় ছয় বছরে ৯.২ মিলিয়ন টন পাথর উত্তোলনের জন্য নিয়োগ দেয়া হয় তাদের।

অবশ্য কোম্পানিটি ২০১৯ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে মাত্র ৩.৭৫ মিলিয়ন টন পাথর উত্তোলন করতে সক্ষম হয়েছিল। সেই ঘাটতি সত্ত্বেও, এমজিএমসিএল ২০২১ সালে জিটিসি এর সাথে আরও ছয় বছরের জন্য আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।

এমজিএমসিএল-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক জরিপ ২০১৯ সালে একটি জরিপ চালিয়ে দেখায় ২.২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১.৩৯ বিলিয়ন টন পাথর মজুদ রয়েছে এবং এর মধ্যে প্রায় ১.১৩ বিলিয়ন টন পুনরুদ্ধারযোগ্য।

এমজিএমসিএল বর্তমানে প্রতিদিন ৫ হাজার টন পাথর উত্পাদন করে তবে নতুন খনি থেকে প্রতিদিন ১১ হাজার টন উত্তোলন করা হবে এবং বার্ষিক উত্পাদন হবে ৩.৩ মিলিয়ন টন।

নতুন খনি

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ মধ্যপাড়ায় নতুন খনির মজুদ ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রতিবেদন পেশ করে। এরপর কমিটি নতুন খনির জন্য প্রাথমিক অনুমোদন দেয়।

দ্য বিজনেস পোস্টের সাথে আলাপকালে এমজিএমসিএল-এর একজন জেনারেল ম্যানেজার, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “অর্থায়ন একটি বড় সমস্যা। মধ্যপাড়ায় নতুন খনিটি নির্মাণে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা লাগবে।”

“বিদেশি ঠিকাদারদের কাজ আউটসোর্স করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর যেহেতু তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। আমরা খুব শীঘ্রই তার সামনে বিষয়টি উপস্থাপনা করব।”

এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মোঃ কামরুজ্জামান খান বলেন, লাভ বণ্টন নীতির ভিত্তিতে উৎপাদন-বণ্টন চুক্তির আওতায় নতুন খনি তৈরি করা যায় কিনা সে ‍বিষয়ে আলোচনা চলছে।

“এই মুহূর্তে পেট্রোবাংলা বা এমজিএমসিএলের কাছে এই নতুন খনি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নেই। এছাড়াও, আমাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নত নয়। এ কারণে, ঠিকাদার নিয়োগ করা আবশ্যক।”

পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, দেশের বার্ষিক পাথরের চাহিদা ১০.৫ মিলিয়ন টন এবং এমজিএমসিএল সরবরাহ করে মাত্র ১ মিলিয়ন টন। এ কারণে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানির মাধ্যমে নির্মাণ সামগ্রীর প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটায়।

এমজিএমসিএল কর্মকর্তাদের দাবি, মধ্যপাড়া খনি থেকে পাওয়া পাথর আন্তর্জাতিক মানের এবং সেগুলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে।

যেহেতু সাম্প্রতিক বছরগুলিতে উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, সেজন্য সরকার এখন মধ্যপাড়ায় নতুন খনি তৈরির পরিকল্পনা করছে। এর ফলে আমদানি নির্ভরতা কমবে এবং স্থানীয় খনি থেকে অভ্যন্তরীণ পাথরের চাহিদা মিটবে।