বহুল আলোচিত ও প্রতীক্ষিত সার্বিকভাবে ব্যলেন্স ও নিরাপদ সমাজ ব্যবস্থার কর্মসূচি সর্বজনীন পেনশন স্কিম আজ বৃহস্পতিবার চালু হয়েছে। এই স্কিম উদ্বোধনের মাধ্যমে দেশের সব নাগরিকদের জন্য নতুন যুগের সূচনা হলো। আজ থেকেই যা সবার জন্য উন্মুক্ত।
আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি সর্বজনীন পেনশন স্কিম ১৫ বছর পরে আজ বাস্তব রূপ পেলো। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনগণকে পেনশনের আওতায় আনার উদ্দেশ্যে আজ সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সবার জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন ২০২৩’ প্রণয়ন করা হয়। এর পরে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কর্তপক্ষ গঠন করে সরকার। গত ১৩ আগস্ট রোবাবর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা-২০২৩ এর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, সর্বজনীন পেনশনে চারটি স্কিমের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন নিবন্ধিত ব্যক্তি। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের কর্মচারীরা প্রগতি স্কিম, প্রবাসীদের জন্য প্রবাস স্কিম, স্বকর্মে নিয়োজিত সুরক্ষা স্কিম ও স্বল্প আয়ের নাগরিকরা সমতা স্কিমে যুক্ত হতে পারবেন। এসব স্কিমের চাঁদার ভিত্তিতে মোট জমা অর্থের সর্বনিম্ন ২.৩০ গুণ থেকে সর্বোচ্চ ১২.৩১ গুণ অর্থ পেনশন হিসেবে পাবেন। নূন্যতম চাঁদা ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত ১০ বছর থেকে ৪২ বছর পর্যন্ত মোট ৮টি মেয়াদে স্কিম রয়েছে।
বিধিমালায় বলা হয়, বেসরকারি চাকরিজীবিদের জন্য প্রগতি স্কিমের অর্ধেক চাঁদা দেবে প্রতিষ্ঠান মালিক এবং বাকি অর্ধেক কর্মচারী দেবেন। এছাড়া সমতা স্কিমের অর্ধেক সরকার পরিশোধ করবে।
বিধিমালায় বলা হয়, স্কিমের আওতাভুক্ত প্রত্যেক চাঁদাদাতার নামে আলাদা পেনশন হিসাব থাকবে। যা কর্পাস হিসাব হবে। ওই কর্পাস হিসাবে চাঁদাদাতার জমা চাঁদার অংক হিসাব করা হবে। প্রতি অর্থ বছর শেষে নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী অনুযায়ী কর্পাস হিসাবের স্থিতির উপর লভ্যাংশ ঘোষণা করবে কর্তৃপক্ষ। জমা করা চাঁদার উপর ঘোষিত নির্ধারিত হারে লভ্যাংশ কর্পাস হিসাবের পুঞ্জীভূত জমার পরিমাণ নির্ধারিত হবে। এই জমার ভিত্তিতে মাসিক পেনশনের পরিমাণ নিরূপণ করা হবে।
বিধি অনুযায়ী, পেনশন নিবন্ধন করতে হলে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী জাতীয় পরিচয়পত্রধারী সব বাংলাদেশিরা স্কিমে অংশগ্রহণের যোগ্য হবেন। প্রবাসী বাংলাদেশি যাদের এনআইডি নেই, তারা বৈধ পাসপোর্টের ভিত্তিতে নিবন্ধন করতে পারবেন। তবে বয়স্ক নাগরিকদের জন্য একটি টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় ৫০ পার হওয়া ব্যক্তিরা এর আওতায় অংশ নিতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে স্কিমে অংশ গ্রহণ থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ১০ বছর নির্দিষ্ট হারে চাঁদা পরিশোধ শেষে যে বয়সে উপনীত হবেন সেই বয়স থেকে আজীবন পেনশন পাওয়ার সুযোগ থাকবে। তবে স্কিমে অংশ নেওয়ার আগে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা সমর্পণ করতে হবে। নূন্যতম ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পেনশন সুবিধা পেতে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর চাঁদার হার এবং স্কিম পরিবর্তন করার সুযোগ থাকবে।
বিধিমালা থেকে জানা যায়, নগদে পরিশোধ নয়, ডিজিটাল পদ্ধতিতে পেনশন কর্মসূচির চাঁদা দিতে হবে। এ জন্য একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। চাঁদাদাতারা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, অনলাইন ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ও তফসিলি ব্যাংকের শাখায় ওটিসি (ওভার দ্যা কাউন্টার) পদ্ধতিতে কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত ব্যাংক হিসাবে মাসিক চাঁদা জমা দেবেন। চাঁদা দিতে ব্যর্থ হলে এক মাস পর্যন্ত জরিমানা ছাড়া দেওয়া যাবে। এর পর প্রতি দিনের জন্য ১ শতাংশ বিলম্ব ফি দিতে হবে। চাঁদাদাতা ধারাবাহিকভাবে ৩ কিস্তি চাঁদা দিতে ব্যর্থ হলে পেনশন হিসাব স্থগিত হবে। অসচ্ছল হলে এক বছর পর্যন্ত চাঁদা পরিশোধ না করলেও চাঁদাদাতার পেনশন হিসাব স্থগিত হবে না। হিসাব স্থগিত হলে সব বকেয়া কিস্তি পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত হিসাব সচল হবে না।
বিধিতে বলা হয়, স্কিমে নিবন্ধনের জন্য দেশে এবং প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকরা কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত ফরম অনলাইনে পূরণ করে আবেদন করতে হবে। নিবন্ধনের পর আবেদনকারীর মোবাইল নম্বরে এবং প্রবাসীদের স্বয়ংক্রিয় ই-মেইলের মাধ্যমে একটি ইউনিক আইডি নম্বর, চাঁদার হার এবং মাসিক চাঁদা দেওয়ার তারিখ পাওয়া যাবে, যা দিয়ে সব সময় চাঁদা পরিশোধসহ সব কাজ করা যাবে।
জানা যায়, প্রামীণ পর্যায়ে নিবন্ধন করতে সহযোগিতা করবে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার।
বিধিমালায় উল্লেখ রয়েছে, পেনশন স্কিমে জমা করা অর্থের ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে নেওয়া যাবে। তবে এই ঋণের অর্থ ২৪ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াত পাওয়া যাবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ পাওয়া অর্থও করমুক্ত থাকবে। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগেই মারা গেলে, তাঁর জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তাঁর নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা কার্যকর হলে ধীরে ধীরে বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাভোগীর সংখ্যা কমিয়ে আনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কারণ, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় দেশের বয়স্ক জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি পেনশন ব্যবস্থা সরকারি রাজস্বের উৎস হিসেবে কাজ করবে। কারণ সরকার প্রাথমিক ১০ বছরের জন্য একটি প্রিমিয়াম পাবে। এ সময়ের মধ্যে কোনো পেনশন দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এ ছাড়া প্রবাসীদের ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়া হবে। তবে দেশে আসলে তখন চাঁদা স্থানীয় মুদ্রায় দেওয়া যাবে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে। এদিকে পেনশনভোগীদের প্রাপ্ত পেনশন সুবিধা দিতে সরকারের বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হবে না। পেনশনভোগীদের দেওয়া চাঁদার ওপর বার্ষিক ৮ শতাংশ হারে সুদ ধরেই এ অর্থের জোগান দেওয়া সম্ভব। আর সরকার পেনশন তহবিল থেকে পাওয়া অর্থ বিভিন্ন লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করবে।
আপাতত সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ পেনশন কর্মসূচির বাইরে থাকবেন। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত নাগরিকদের এ ব্যবস্থায় রাখা হবে না। সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধাভোগী তাঁর সুবিধা সমর্পণ করে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। সব স্কিমেই চাঁদার উপর ভিত্তি করে একই হারে পেনশন সুবিধা দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে চাঁদার পরিমান ও পরিশোধের বছরের উপর মাসিক পেনশনের পরিমান নির্ভর করবে।
বেসরকারি কর্মচারীদের জন্য ‘প্রগতি স্কিম’
বেসরকারি কর্মচারীরা মাসিক ২,০০০, ৩,০০০ ও ৫,০০০ টাকা চাঁদা দিয়ে প্রগতি স্কিমে যুক্ত হতে পারবেন। চাঁদার ৫০ শতাংশ কর্মীরা এবং বাকি ৫০ শতাংশ কোম্পানি পরিশোধ করবে। কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশ না নিলে এর কর্মীরা স্বউদ্যোগে এতে অংশ নিতে পারবেন। বেসরকারি কর্মীরা ১৮ বছর বয়সে এ স্কিমে যোগ দিয়ে কোনো ব্যক্তি ৪২ বছরে মাসিক ২,০০০ টাকা চাঁদা দিলে ৬০ বছর বয়স থেকে তিনি মাসে ৬৮,৯৩১ টাকা পেনশন পাবেন। একই মেয়াদে ৩,০০০ টাকা মাসিক চাঁদায় ১,০৩,৩৯৬ টাকা মাসিক পেনশন পাবেন। ৫,০০০ টাকা মাসিক চাঁদায় ১,৭২,৩২৭ টাকা মাসিক পেনশন পাওয়া যাবে। অর্থাৎ এ স্কিমে ৪২ বছর ধরে ৫ হাজার টাকা করে মাসিক চাঁদা দেওয়া হলে ন্যূনতম ৭৫ বছর পর্যন্ত সময়ে পেনশন হিসাবে মোট পাওয়া যাবে ৩,১০,১৮,৮৬০ টাকা, যা মোট চাঁদার প্রায় ১২.৩১ গুণ। তবে এ স্কিমে ১০ বছরে ধরে প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ২,০০০ টাকা করে দিলে ৬০ বছর বয়সের পর প্রতি বছর পাওয়া যাবে ৩,০৬০ টাকা। এ ক্ষেত্রেও মোট চাঁদার তুলনায় ২. ৩০ গুণ বেশি পেনশন পাওয়া যাবে।
প্রবাসীদের জন্য ‘প্রবাস স্কিম’
প্রবাসীদের জন্য প্রবাস স্কিমে মাসিক চাঁদা ধরা হয়েছে ৫,০০০, ৭,৫০০ এবং ১০,০০০ টাকা। বিদেশ থেকে এ স্কিমে যোগদানের পর ৬০ বছর বয়সের আগেই কেউ দেশে ফিরলে তারা দেশীয় মুদ্রায় চাঁদা পরিশোধ করতে পারবেন অথবা স্কিম পরিবর্তন করতে পারবেন। পেনশন স্কিমের মেয়াদ শেষে স্থানীয় মুদ্রায় পেনশন দেওয়া হবে। একজন প্রবাসী ১৮ বছর বয়সে এ স্কিমে যুক্ত হয়ে ৪২ বছর ধরে প্রতি মাসে ১০,০০০ টাকা চাঁদা দিলে ৬০ বছর বয়স পর তিনি সরকারি তহবিলে মোট ৫০,৪০,০০০ টাকার চাঁদা দেবেন। এর পর ৬০ বছর থেকে ন্যূনতম ৭৫ বছর পর্যন্ত মাসিক ৩,৪৪,৬৫৫ টাকা করে পাবেন। ন্যূনতম ১০ বছর ১০,০০০ টাকা চাঁদা দিলে প্রতি মাসে ১৫,৩০২ টাকা পেনশন, চাঁদা ৭,৫০০ টাকা দিলে ১১,৪৭৭ টাকা পেনশন, চাঁদা ৫,০০০ টাকা দিলে ৭,৬৫১ টাকা পেনশন পাবেন।
অনানুষ্ঠানিক খাতের জন্য ‘সুরক্ষা’
অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’ নামে স্কিম থাকছে। কৃষক, রিকশাচালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতিসহ সব ধরনের অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিরা এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। এ স্কিমে মাসিক চাঁদার পরিমাণ ১,০০০, ২,০০০, ৩,০০০ ও ৫,০০০ টাকা। সুরক্ষা স্কিমে ৪২ বছর ধরে প্রতি মাসে ১,০০০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে ৬০ বছর বয়স থেকে মাসে ৩৪,৪৬৫ টাকা করে পেনশন পাওয়া যাবে। একই মেয়াদে ২,০০০ টাকা করে চাঁদা দিলে ৬০ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে ৬৮,৯৩১ টাকার পেনশন পাওয়া যাবে। প্রতি মাসে ৩,০০০ টাকা চাঁদা দিলে মাসিক ১,০৩,৩৯৬ টাকা এবং প্রতি মাসে ৫,০০০ টাকা চাঁদা দিলে মাসিক ১,৭২,৩২৭ টাকা করে পেনশন পাবেন।
অতিদরিদ্রদের জন্য ‘সমতা’
সমতা স্কিমে চাঁদার পরিমাণ মাসে ১,০০০ টাকা। এর মধ্যে গ্রাহক প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে দেবেন। বাকি ৫০০ টাকা সরকার পরিশোধ করবে। খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী অতিদরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হবে। এ স্কিমের আওতায় ১৮ বছর বয়সে অন্তর্ভুক্ত হয়ে মাসে ৫০০ টাকা চাঁদা দিলে ৬০ বছর বয়স থেকে মাসিক ৩৪,৪৬৫ টাকা পেনশন পাওয়া যাবে। আর ৫০ বা তদূর্ধ্ব বয়সীরা অন্তত ১০ বছর ধরে মাসে ৫০০ টাকা চাঁদা পরিশোধের পর থেকে মাসিক ১,৫৩০ টাকা করে পেনশন পাবেন। সব স্কিমে ১০ বছর, ১৫ বছর, ২০ বছর, ২৫ বছর, ৩০ বছর, ৩৫ বছর, ৪০ বছর ও ৪২ বছর এই আটটি স্লাবে ভাগ করে মাসিক পেনশন সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে।