বর্তমানে নদী দখলের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, দেশের বেশিরভাগ নদী তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। শুধু তাই নয়, নদীর জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে নেওয়া হচ্ছে ঋণ। আবার এ ঋণ পরিশোধের জন্য নদীর দখলকৃত জমিও বিক্রি করে দিচ্ছেন দখলদাররা।
কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে কুড়িগ্রামের রাজারহাটে চাকিরপাশা নদী দখল এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, ১২ বছর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক থেকে ৮৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন রাজারহাট উপজেলা কৃষক লীগের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ ইউনুস আলী। সুদসহ এ ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ দশমিক ৬ কোটি টাকা। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে তিনি গত বছর চাকিরপাশা নদীর ১৭ একর দখলকৃত জমি জেলার উলিপুর উপজেলার এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেন।
রাজারহাট ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের তথ্যানুসারে, তিনি বেসিক ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা জমিটি এক দশমিক ৭০ কোটি টাকায় বিক্রি করেছিলেন।
ন্যাশনাল রিভার কনজারভেশন কমিশন (এনআরসিসি) কর্মকর্তা এবং স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা চাকিরপাশা নদী রক্ষায় ব্যর্থতার কারণ হিসেবে স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও অবহেলাকে উল্লেখ করেছেন। যদিও সেই সময় এনআরসিসিকে পাঠানো এক চিঠিতে জেলা প্রশাসন দাবি করেছিল যে চাকিরপাশা নদীর দখলকৃত জমি উদ্ধারের প্রক্রিয়া চলছে।
যোগাযোগ করা হলে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ সাইদুল আরিফ গত সোমবার দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, ‘চাকিরপাশা নদী উদ্ধারে প্রশাসন সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ২২ চিহ্নিত দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রায় ১২৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই চাকিরপাশা নদী উদ্ধার হবে।’
এ বিষয়ে দ্য বিজনেস পোস্টের প্রাপ্ত নথি অনুসারে, ভারতের প্রথম সম্পূর্ণ ক্যাডাস্ট্রাল জরিপ (সিএস) ১৮৮৭ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ চাকিরপাশাকে একটি নদী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। যা রাজারহাটের ইটাকুরির নিম্ন এলাকা থেকে উৎপন্ন হয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলায় ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হয়েছে। তিস্তার একটি উপনদী হওয়ায় নদীটি স্থানীয়ভাবে মোরা তিস্তা, বুড়ি তিস্তা বা চাকিরপাশা নামে পরিচিত ছিলো।
২০২০ সালের কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে দেওয়া এক চিঠিতে জানায়, চাকিরপশার নদীতে সরকারি জমির মোট আয়তন সিএস মূলে ৩০৬ একর। কিন্তু ২০২২ সালে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের একটি চিঠির সূত্রে জানা যায়, আরএস রেকর্ডে এই জমির পরিমাণ মাত্র ৩৬ দশমিক ২৮ একর। সিএস রেকর্ডে ৩০৬ একরের মধ্যে ২৬৯.৭২ একর জমি বিভিন্ন ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়া হয়েছে।
একই বছর ২২ জন দখলদারের নাম উল্লেখ করে ওই চিঠিতে জেলা প্রশাসক বলেছিলেন, ‘দখলদারদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চলমান আছে।’ তালিকায় সপ্তম স্থানে রয়েছে ইউনুস আলীর নাম।
স্থানীয়রা জানায়, ইউনুস আলী ছয়টি পুকুর খনন করে চাকিরপাশা নদীতে ৩৪ একর জমিতে একটি কৃষি খামার গড়ে তোলেন। ২০১০ সালে এই জমি বন্ধক রেখে বেসিক ব্যাংকের রংপুর শাখা থেকে ৮৫ লাখ টাকা ঋণ নেন তিনি। পরে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে ২০২২ সালে উলিপুর উপজেলার এক ব্যবসায়ীর কাছে বন্ধক রাখা ১৭ একর জমি বিক্রি করে দেন।
নদীর জমি কীভাবে বিক্রি করলেন জানতে চাইলে ইউনুস আলী বিজনেস পোস্টকে বলেন, ‘এটা নদীর জমি কিনা জানি না। এটি সিএস রেকর্ডে জলাভূমি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে এই জমি নদীর দখলে।’
জেলা প্রশাসনের দখলদারদের তালিকায় তার নাম রয়েছে স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমার নাম তালিকায় আছে। কিন্তু জেলা প্রশাসন তালিকার অন্যদের কাছে জমি হস্তান্তরের জন্য চিঠি পাঠালেও তারা আমাকে কিছুই জানায়নি।’
স্থানীয় জেলে আবুল কালাম বলেন, ‘ইউনুস আলী নদীর মূল প্রবাহ এলাকা দখল করে রেখেছেন। কিছু নিচু জমিতে তিনি ধান চাষ করেছেন। প্রভাব খাটিয়ে তিনি নদীর জায়গা দখল করে নিয়েছেন।’
এ বিষয়ে বেসিক ব্যাংকের রংপুর শাখার ব্যবস্থাপক আবদুল কুদ্দুস সরকার বলেন, ‘২০১০ সালে ইউনুস আলী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। আমি গত জানুয়ারিতে এই শাখায় যোগ দিয়েছি। এ ঋণ দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে পারব।’
এনআরসিসি গত দুই বছরে জেলা প্রশাসনকে ছয়বার চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে নদী দখলদারদের উচ্ছেদ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এনআরসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘চাকিরপাশা নদীর জমি বিক্রি খুবই উদ্বেগের বিষয়। নদী রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি, যা কোনোভাবেই হস্তান্তর করা যায় না।’
রিভারাইন পিপলস’র নির্বাহী পরিচালক এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, ‘সিএস রেকর্ডে চাকিরপাশাকে প্রবাহিত নদী হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে ভূমি অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় নদীর তীরবর্তী বেশ কিছু জমি এসএ রেকর্ডে অনুযায়ী দখলদারদের নামে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে।’
তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘এখনও নদীর জমি বিক্রি করে ইজারা দেওয়া হচ্ছে। যা শেষ পর্যন্ত নদী হত্যার শামিল।’