গাজায় যে হত্যাযজ্ঞ চলছে তা নিয়ে আমেরিকা ও ইউরোপে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ-মানববন্ধন হলেও বাংলাদেশ-ভারতসহ এশিয়ার কোনো দেশে সেভাবে হচ্ছে না। খাবার টেবিলে খেতে খেতে মানুষ হত্যাযজ্ঞ দেখছে, কিন্তু কোনো কথা বলছে না। দিন দিন নাগরিক সমাজের মানবিকতা ক্ষয়ে যাচ্ছে।
‘শাহ আলমগীর জার্নালিজম এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণের পর একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত সাংবাদিক ও নতুন ধারার দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক আবুল মোমেন এসব কথা বলেন।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে তার হাতে এই পদক তুলে দেওয়া হয়। প্রয়াত সাংবাদিক শাহ আলমগীরের স্মৃতির সম্মানে ‘শাহ আলমগীর জার্নালিজম এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ প্রবর্তন করে ‘ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার’ (বিজেসি)।
প্রতিক্রিয়ায় আবুল মোমেন বলেন, ‘দেখতে দেখতে আমাদের বয়স অনেক হয়ে যাচ্ছে। অনেক রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। নানা রকম স্বীকৃতি-পুরস্কারও পেয়েছি। তবে আমি বলব, আজকে এখানে এসে এই আয়োজনের পেছনে আমি দেখতে পেয়েছি- সকলের আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। যার স্মরণে এই আয়োজন তার প্রতি যেমন এবং যাকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা হলো তার প্রতিও তাদের আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শন রয়েছে। ’
তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক সময় অনেক কাজ করি নানা রকম দায়িত্ববোধ থেকে। কিন্তু আমরা কর্তব্য হিসেবে কাজ করি না। আমরা অনেক রকম যোগ্য-দক্ষ-পেশাদার পাই কিন্তু যুগপৎ, ভালো পেশাদার মানুষের আকাল দেখা দিয়েছে। আমি বুঝতে পারি- আপনারা শাহ আলমের মধ্যে সেই মানবসত্ত্বাটিকে খুঁজে পেয়েছিলেন।’
আজকাল বাংলাদেশে সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের অভাব নেই জানিয়ে দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক বলেন, ‘কারণে এবং অকারণে অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অনেক চ্যানেল, অনেক রকম অনলাইন নিউজ পোর্টাল দেখতে পাই। কিন্তু ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমরা খুঁজে পাই না এটা কেন বের করছে। কোনো কোনো পত্রিকায় মাসের পর মাস কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। অনেক সংবাদপত্রে শুনি বেতন দেওয়া খুব কঠিন। অনেক সাংবাদিক সচিবালয়ে যান খবর সংগ্রহ করতে। আবার অনেকে সচিবালয়ে যান ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে এবং তারা অন্যের হয়ে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য তৈরি থাকেন। ফলে সাংবাদিকের যে মৌলিক সত্ত্বা তা ক্ষুণ্ণ হয়। এমন পরিস্থিতিতে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করা কঠিন হয়ে পড়ে।’
আবুল মোমেন বলেন, ‘অনেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন এই জন্য যে সাংবাদিকদের গতিবিধি সর্বত্র। সাংবাদিক যে কোনোখানে ঢুকে যেতে পারে। মাঝে মাঝে এটি এতই বিব্রতকর।’
তিনি বলেন, ‘যেকোনো জায়গায় এখন প্রিন্ট মিডিয়ার একটু আকাল যাচ্ছে। কারণ, প্রিন্ট মিডিয়ার সর্বত্রই সার্কুলেশনের দিক থেকে কমে আসছে। কিন্তু তারপরও টিকে থাকবে যেভাবে বই টিকে আছে। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে সমাজটা ক্রমশ একটা ক্ষমতার জায়গা হয়ে উঠছে।’
দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক বলেন, মানুষ যে রাজনীতির দিকে ঝুঁকছে, রাজনীতিকে ব্যবহার করছে, রাজনীতিবিদদের সঙ্গে একটা ব্যক্কিতগত সম্পর্ক রক্ষা করাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। কারণ, সমাজে সার্বিকভাবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা গ্রহণ করে ফেলেছে সামাজিক একটি ক্ষেত্র যেটাতে রাজনীতির লোকেরা অবস্থান করছে।’
তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী থেকে শুরু নিচে ইউপি মেম্বার পর্যন্ত তারা প্রত্যেকেই যেটা প্রদর্শন করছে সেটা ক্ষমতার শক্তির প্রদর্শন। সাধারণ মানুষ এই অসীম শক্তিধর মানুষদের অবশ্যই ভয় পায়। ফলে ভেতরে ভেতরে সমাজের মধ্যে একটা ভয়ের সংস্কৃতি কিন্তু তৈরি হচ্ছে। ক্ষমতা যত প্রভাব বিস্তার করবে ততই এটা প্রবল হতে থাকবে। ’
‘সমাজের একেবারে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত যে যত ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছে, সে নির্বাচিত ব্যক্তি হিসেবে অথবা কোনো একটি অঙ্গ সংগঠনের অংশ হিসেবে হতে পারে, এরপর তারা ক্ষমতা ব্যবহার করছে। ফলে সমাজব্যাপী একটা অব্যবস্থা চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি সাংবাদিকতা সমাজের নিরীক্ষণের কাজ করে থাকে, সাংবাদিকতা একটা ওয়াচডগের কাজ করে থাকে তাহলে সমাজে যে ব্যধি তৈরি হচ্ছে ভীতির সংস্কৃতি। ফলে মানুষ যে মুক্তভাবে চিন্তা করবে সেই জায়গাটা ধাকছে না। সেটাকে আমরা তুলে ধরতে পারছি না। সেটা আমাদের সাংবাদিকদের জন্য অবশ্যই ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
আবুল মোমেন বলেন, ‘যে ভূমিকা সাংবাদিকের হওয়ার কথা সেটা আসলে অনেক জায়গায় কার্টেল হচ্ছে। আমরা নিজেরাই সেটা কার্টেল করে নিয়ে এক্জিট করছি। সাংবাদিকতার যে গুণ সেটি আসলে কার্যকর সিদ্ধ হচ্ছে না। ফলে এটাও সমাজের একটা সমস্যা তৈরি করছে।’
এ কারণে মানবসমাজ আমাদের চোখের সামনে তার মূল্যবোধ এবং তার যে মানবিক চেতনা ও সংবেদনশীলতা সব হারিয়ে ফেলছে যোগ করেন আমাদের সময়ের সম্পাদক।
তিনি আরও বলেন, ‘সাংবাদিকতার যে কাজ সেই কাজটাতে আমি সফল হব তখন, যখন আমি নিজের কথা না ভেবে সমাজের কথা ভেবে কাজ করব। আজকে আপনারা যে শাহ আলমগীরকে স্মরণ করছেন তাকে যেভাবে আস্থায় নিয়েছেন যে এই লোকটা একজন ভালো সাংবাদিক। এই লোকটা একজন ভালো মানুষ। হয়তো আপনারা একইভাবে আমাকে আস্থায় নিয়েছেন সেই জায়গা থেকে আমি পুুরস্কারটাকে গ্রহণ করে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি আপনাদের যে আস্থা অর্জন করেছি সেটি আপনার বলেছেন এখানেই আমরা কৃতজ্ঞতা।’