পুরান ঢাকা অপরিকল্পিত শহর হওয়ায় সরু সড়ক, ঘনবসতিপূর্ণ আবাস, অপরিকল্পিত দালানসহ বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এই শহরের ঐতিহ্য ধরে রেখে সংস্কার কাজ শুরু করার পরিকল্পনা নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
পুনঃ উন্নয়নের অংশ হিসাবে প্রাথমিকভাবে সাতটি স্থান নির্ধারণ করেছে রাজউক। ইসলামপুর, চকবাজার, বংশাল, মৌলভীবাজার, হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকা, কামরাঙ্গীরচর ও সোয়ারিঘাট এই সাত স্থানের ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্যতা যাচাই) শুরু হবে।
পুরান ঢাকা অপরিকল্পিত শহর হওয়ায় বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এর কারণ শহরটি সরু সড়ক, ঘনবসতিপূর্ণ আবাস, অপরিকল্পিত দালান, ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যুৎ সংযোগ, অপর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, উন্মুক্ত স্থানের ঘাটতি, ত্রুটিপূর্ণ ড্রেনেজ ব্যবস্থা, উচ্চ ঘনত্ব, নিম্নমানের জীবনযাপন, ভূমিকম্প ও অগ্নি দুর্ঘটনাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। সেজন্য এখানে বসবাস করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে পুরান ঢাকায় নাগরিক সুবিধা বলতে কিছুই নেই, ফলে পুরান ঢাকাতে আধুনিক শহরে রুপান্তর করতে রাজউক রিডেভেলপমেন্ট করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিয়া বলেন, ‘পুরান ঢাকাকে আধুনিক সুযোগ সুবিধা দিয়ে রিডেভেলপমেন্টের কাজ করতে ইতোমধ্যে জাপান, চায়নাসহ বেশ কয়েকটি দাতা সংস্থার সাথে বৈঠক হয়েছে। এ বিষয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। খুব কম সুদে এই কাজটি করা হবে।’
রাজউক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম জানান, পুরান ঢাকার ইসলামুর, চকবাজার, বংশাল, মৌলভীবাজার, হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকা, কামরাঙ্গীরচর ও সোয়ারিঘাট এই সাতটি স্থানে আগে ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হবে। তারপর পাইলটিং হিসাবে শুরুতে দুয়েকটি স্থানে কাজ শুরু করা হবে। তারপর বাকি গুলো শুরু হবে।
কবে নাগাদ ফিজিবিলিটি স্টাডি শুরু হবে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘আগামী দুয়েক মাসের মধ্যে সাতটি স্পটে ফিজিভিলিটি শুরু হবে।’
রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, পুরান ঢাকার এক কাঠা, দুই কাঠা জমিতে অপরিকল্পিতভাবে বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এমনও দেখা গেছে, এক দেয়ালে দুই ভবন তৈরি করা হয়েছে। ভেতরে আলো-বাতাস ঢোকার কোনো ব্যবস্থা নেই। এমন ছোট ছোট জমিগুলো একত্র করে ব্লক ভিত্তিক পূর্ণ উন্নয়ন করা হবে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে পুরান ঢাকার মানুষের মতামতকে।
রিডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে পুনঃউন্নয়ন পদ্ধতি বলতে রাজউকের চেয়ারমজান জানান, কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় বাসিন্দাদের ছোট ছোট আয়তনের জমি একত্রিত করে ব্লক ভিত্তিক উন্নয়ন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পত্তির মালিকরা আনুপাতিক হিসাবে সম্পত্তির মালিক হবেন। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অপরিকল্পিত, ঘনবসতিপূর্ণ, অপ্রতুল নাগরিক সুবিধা সম্পন্ন এলাকার বাসিন্দাদের চাহিদা ও ঐক্যমতের ভিত্তিতে তাদের মতামতগুলোকে সন্নিবেশিত করে পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধা সম্পন্ন একটি পরিকল্পিত এলাকা হিসাবে গড়ে তোলা।
চেয়ারম্যান বলেন, এ প্রক্রিয়ায় ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। যেমন, পূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প এলাকায় পুরানো জরাজীর্ণ ভবন অপসারণ করে নতুন ভবন নির্মান করা হবে। এর মাধ্যমে ভূমির যথাযথ ব্যবহারে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা তৈরি হয়, সেখানে পার্ক, খেলার মাঠ, অন্যান্য নাগরিক সুবিধাদি, প্রশস্ত সড়ক প্রভৃতি সংস্থান করা যাবে। তবে প্রকল্প এলাকায় হেরিটেজ হিসাবে বা অন্যান্য দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ কিছু স্থাপনা সংরক্ষণ করার বিষয়ে বিবেচনা করা হবে।
তিনি বলেন, এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে পুরান ঢাকায় যে দুর্ঘটনা ঘটছে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই তা থেকে বাঁচার উপায় হয়ে দাঁড়াবে। আমরা আশা করছি, পুরান ঢাকার জনগণ আমাদেরকে সহযোগিতা করবে এবং এই সহযোগিতা যদি সবাই করে তাহলে আমি মনে করি পুরান ঢাকায় যেসকল ঝুঁকি ও চলাচলে অব্যবস্থাপনা আছে তা দুর হবে। যাদের জমি, মালিকানা তাদেরই থাকবে। মালিকানা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আটটি থানার ১১টি ওয়ার্ড নিয়ে পুরান ঢাকা। এর মধ্যে প্রধান এলাকাগুলো হচ্ছে- লালবাগ, হাজারীবাগ, চকবাজার, বংশাল, সূত্রাপুর, সদরঘাট, কোতোয়ালি, ইসলামপুর, বাবুবাজার, ওয়ারী, গেন্ডারিয়া, শাঁখারীবাজার, গোলনগর, লক্ষ্মীবাজার, তাঁতিবাজার ও বাংলাবাজার।
ড্যাপের (ডিটেইল্ড এরিয়া ম্যাপ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় পাঁচ ফুট প্রশস্তের নিচে ১০ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার, ৫-১০ ফুটের ৪৭ দশমিক ৫০ কিলোমিটার, ১০-১৫ ফুটের ৩২ দশমিক ৬৪ কিলোমিটার, ১৫-২০ ফুটের ১৬ দশমিক ৪৮ কিলোমিটার, ২০-৩০ ফুটের ১২ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার, ৩০-৫০ ফুটের ৩ দশমিক ৬০ কিলোমিটার, ৫০ থেকে ১০০ ফুট প্রশস্তের ৪ দশমিক ৩১ কিলোমিটার এবং ১০০ ফুট প্রশস্তের ওপরে মাত্র শূন্য দশমিক ৪ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে।
এ ছাড়া ড্যাপের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় মোট এক হাজার ১৩১ দশমিক ৪৬ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে আবাসিক হিসাবে ৩৪ দশমিক ৫৪ একর, মিশ্র হিসাবে ২৩ দশমিক ৩৬, পরিবহন ও যোগাযোগের জন্য ১০ দশমিক ৩২, শিক্ষা ও গবেষণার জন্য ৮ দশমিক ৮৯, বাণিজ্যিক হিসাবে ৭ দশমিক ২৭, কমিউনিটি ফ্যাসিলিটিজ হিসাবে ৪ দশমিক ১৯, উন্মুক্ত স্থান হিসাবে ৩ দশমিক ৭৩, সংরক্ষিত হিসাবে ২ দশমিক ১৭, জলাশয় হিসাবে ২ দশমকি ৮, শিল্প হিসাবে ১ দশমিক ৬৬, প্রাতিষ্ঠানিক হিসাবে শূন্য দশমিক ৪৯, স্বাস্থ্যসেবা হিসাবে শূন্য দশমিক ৩১, খালি জায়গা হিসাবে শূন্য দশমিক ৩০ এবং প্রশাসনিক হিসাবে শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ ভূমি ব্যবহার হচ্ছে।
পুরান ঢাকার ১১টি ওয়ার্ডে বর্তমানে ২৪ হাজার ৫০৪টি ভবন রয়েছে। এরমধ্যে একতলা ৯ হাজার ২৮২টি, দোতলা তিন হাজার ৭৩৯টি, তিনতলা দুই হাজার ৭২৪টি, চারতলা দুই হাজার ৭০৫টি, পাঁচতলা দুই ৬১১টি, ছয়তলা দুই হাজার ৪৯৭টি, সাততলা ৭২০টি, আটতলা ১২৫টি, ৯ তলা ৪৭টি, ১০ তলা ২৫টি, ১১ তলা ১৭টি এবং ১২ তলার বেশি ১২টি ভবন রয়েছে।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, পুরান ঢাকার উন্নয়ন অবশ্যই ব্লক ভিত্তিক পদ্ধতিতে হবে। পৃথিবীর অনেক শহরে এমন নজির রয়েছে। আমরা সে জন্য এটি একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছি। তবে এতে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। অনেক বাড়ির মালিকের বৈধ কাগজপত্র নেই। এজন্য ভূমি অধিগ্রহণ করে উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। তবে সরকার চাইলে নতুন পদক্ষেপ নিতে পারে।