দেশের প্রথম বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়নে ৪ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিএমইসি)। এটি চলতি বছরের মধ্যে দেশি-বিদেশি কোম্পানির সর্বোচ্চ বিনিয়োগ নিবন্ধন।
গত মার্চ মাসে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চীনা বিনিয়োগে নতুন কোম্পানি ডব্লিউটিই পাওয়ার প্ল্যান্ট নর্থ ঢাকা প্রাইভেট লিমিটেড নামে নিবন্ধন করেছে সিএমইসি।
কোম্পানির নিবন্ধনে উল্লেখ করা হয়, এই বিনিয়োগের মাধ্যমে ‘বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও দূরীকরণ কার্যক্রম’ খাতে ‘বিপদহীন বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত ও পূণর্ব্যবহারের উপযোগী’ প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। উচ্চ প্রযুক্তির এ প্লান্টে মাত্র ২২ জন লোকের কর্মসংস্থান হবে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে এই বিনিয়োগের তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, কোম্পানিটি নিজ দায়িত্বে প্লান্ট স্থাপনসহ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এ প্লান্টে উৎপাদিত বিদ্যুৎ তারা বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে বিক্রয় করবে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিক্রির মাধ্যমে তারা তাদের ব্যয় নির্বাহ করবে।
বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট তৈরির জন্য সাভারের আমিন বাজারে ৩০ একর জমি দেবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। পাশাপাশি নিয়মিত বর্জ্য সরবরাহ করবে সিটি করপোরেশন। প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩ হাজার টন বর্জ্য লাগবে এই প্লান্টে। চুক্তি অনুযায়ী ওই বর্জ্য সরবরাহ করতে না পারলে উত্তর সিটি করপোরেশনকে প্রতি টন ঘাটতি বর্জ্যের জন্যে ১ হাজার টাকা হারে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বিনিয়োগ করা কোম্পানিটিকে।
প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে পরবর্তীতে দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং জেলা পর্যায়েও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা চিন্তা করবে সরকার। ২০২১ সালে ১ ডিসেম্বর বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে স্থানীয় সরকার বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, উত্তর সিটি করপোরেশন এবং চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের মধ্যে এ চুক্তি সই হয়েছিল।
চুক্তি অনুযায়ী, ৪২.৫ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পূর্ণ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পূর্ণ নির্মাণ করবে চীনা এ কোম্পানিটি। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হবে ১৫ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম পড়বে ২১.৭৮ সেন্ট। চুক্তি হওয়ার পরবর্তী ২০ মাসের মধ্যে চায়না কোম্পানিটি এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। তবে ২৫ বছর মেয়াদে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
এর আগে ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কমিটির সভায় সিএমইসি নিজস্ব বিনিয়োগে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করবে এবং সরকার তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়।
জানা যায়, সাধারণত এক টন বর্জ্য থেকে ৫৫০ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। দেশে দৈনিক উৎপাদিত ২০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি বর্জ্যের মাধ্যমে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বা ৩৫ হাজার মেট্রিক টন জৈব সার উৎপাদিত হবে বলে আশা করছে সরকার। বিদ্যুৎ বিভাগের আওতায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে পুরো এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে সিএমইসি।
এর আগে কেরানীগঞ্জে বর্জ্য থেকে জ্বালানি উৎপাদন প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা করা হলেও বিভিন্ন কারিগরি ও আর্থিক সমস্যার কারণে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
বিশ্বের প্রায় সব উন্নত দেশে থাকলেও বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো এ রকম বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শহরের সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ বিভাগ দীর্ঘদিন ধরেই বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করে আসছে, যা এবার বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। এটি একটি নতুন ধরনের পদ্ধতি। মূলত বর্জ্য পুড়িয়েই কারখানায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে এখানে। সিটির বর্জ্য পোড়ানোর পর তা থেকে উৎপাদিত তাপকে কাজে লাগিয়ে নিয়ন্ত্রিতভাবে পানি ফুটিয়ে বাষ্প উৎপাদন করা হবে। আর তা দিয়েই টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।
তুরাগ নদীর কাছাকাছি আমিন বাজার এলাকায় এ বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প নেওয়ার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে আমিন বাজারে ল্যান্ড ফিল্ডের ওপর চাপ কমানো।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) সদস্য (কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স) নাজমুল হাসান দ্য বিজনেস পোস্টকে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। আশা করছেন শিগগিরই উন্নয়ন করা ভূমি হস্তান্তর হলে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মোঃ সেলিম রেজা বলেন, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চীনা বিনিয়োগে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য ইতোমধ্যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এখন ভূমি উন্নয়নের কাজ চলছে। জমির উন্নয়ন দ্রুত শেষ হলে চীনা কোম্পানিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য হস্তান্তর করা হবে।
তিনি বলেন, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী চীনা কোম্পানিকে ৩০০০ মেট্রিক টন বর্জ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ২৫০০ থেকে ২৮০০ মেট্রিক টন বর্জ্য আসছে। যদিও এখন উৎপাদন আরও বেশি হলেও তা হাউজহোল্ড পর্যায়ে কিছু ব্যবহার হচ্ছে। তাছাড়া সিটি কর্পোরেশনে নতুন করে আরও ১৮টি ওয়ার্ড যুক্ত হয়েছে। এসব ওয়ার্ডের বর্জ্যসহ সব মিলিয়ে প্রতিদিন ৩৫০০ মেট্রিক টনের বেশি বর্জ্য উৎপাদন হবে।
সেলিম রেজা বলেন, ডার্ম্পি ইয়ার্ডে বর্জ্য নেয়ার পরে সেখানে সেগ্রিগেট করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপযোগী বর্জ্য দেয়া সম্ভব হবে। এ জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আর যেসব বর্জ্য রিসাইকেল করা যাবে তা বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন সম্ভব হবে।