প্রচ্ছদ ›› জাতীয়

ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলার প্রস্তুতিতে আমলাতন্ত্রই বড় বাধা: ড. মেহেদী আনসারী

নিজস্ব প্রতিবেদক
০৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৬:৩০:২৯ | আপডেট: ১ year আগে
ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলার প্রস্তুতিতে আমলাতন্ত্রই বড় বাধা: ড. মেহেদী আনসারী

অচিরেই বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় শর্টটাইম এবং লংটাইম রোডম্যাপ করা জরুরি। গত ২০/২৫ বছরে ভূমিকম্প ঝুঁকি মোকাবেলায় সচেতনতা তৈরীতে প্রচুর অর্থ খরচ করা হলেও প্রস্তুতিতে তেমন কোন কাজ হয়নি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে গলদ আছে।

৯ ডিসেম্বর ঢাকার এফডিসিতে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি রোধে করণীয় নিয়ে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত ছায়া সংসদে বাংলাদেশ ভূমিকম্প সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী এসব কথা বলেন। 

ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতাই বড় বাধা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে সবাই আমলা। সেখানে কোন ইঞ্জিনিয়ার বা জিওলোজিস্ট নাই। আমলারা দক্ষ জনবলের কথা আমলে নেয় না। রাজউকে এখনো অনিয়ম রয়ে গেছে। এখানে দুর্নীতি হচ্ছে, টাকা ছাড়া কোন কাজ হয় না। বিগত সময়ে যে দুনীর্তি হয়েছে আজ তা সংশোধন করা কঠিন। ইলেকট্রনিক কনস্ট্রাকশন পারমিটিং সিস্টেম (ইসিপিএস) এর মাধ্যমে রাজউকের নকশার অনুমোদন শুরু করা ইতিবাচক। কিন্তু এক্ষেত্রে এখনো স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। ঢাকা শহরে ২১ লাখ ভবনের মধ্যে অকুপেন্সি সনদ প্রদান করা হয়েছে মাত্র ৭০-৮০টি। দুযোর্গ মোকাবেলায় আমরা সক্ষমতা অর্জন করতে পারলেও ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে।’

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ। সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘নগরের ৬৫ শতাংশ ভবনই দুর্বল মাটির উপর নির্মাণ করা হয়েছে। যা ভবন নিরাপত্তা ঝুঁকির অন্যতম কারণ। ভবন নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। রাজউক অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ হচ্ছে কিনা তা নজরদারিতে ঘাটতি রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে রাজউক থেকে নকশার অনুমোদন পেতে এক বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। নির্মাণ শেষে বিল্ডিংয়ের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট পেতেও বেশ কষ্ট হয়। এমনকি নকশা অনুমোদন ও বিল্ডিং কোড মেনে বিল্ডিং করাতে রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। ভবন নির্মাণের অনিয়মের সাথে ভবন মালিক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার কিছু কিছু অসাধু কর্মকর্তারা জড়িত। শুধু ঢাকা শহর নয়, দেশের সব জায়গায় ভবন নির্মাণের সাথে সম্পৃক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ঘুষ, দুনীর্তি ও অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যতক্ষণ পর্যন্ত ভবন নির্মাণের সাথে জড়িত নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৈতিকতার সাথে দায়িত্ব পালন না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নির্মাণ বন্ধ করা সম্ভব হবে না।’

‘তবে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই। ভবন মালিকের ক্যাপাসিটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবেলায় আর্ম ফোর্সেস ডিভিশন, ফায়ার সার্ভিস , দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা শহরে অপরিকল্পিতভাবে মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন নেওয়া হয়েছে। ভূমিকম্প হলে তা অগ্নিকূপে পরিণত হতে পারে। বড় মাত্রার কোন ভূমিকম্পে মৃত্যু হতে পারে আড়াই থেকে ৩ লাখ মানুষের। ভূমিকম্পে ৯০ শতাংশ মানুষই মারা যায় ভবন ধ্বসে। নদী-নালা, খাল-বিল, জলাশয় ভরাট করে যেভাবে ঢাকা শহরের আশেপাশে হাউজিং গড়ে উঠেছে তাতে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে মাটি গলে পানিতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। আমাদের মনে আছে, কোনো রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই রানা প্লাজা ধসে ১১৩৪ জন মানুষ প্রাণ হারায়। তখন মাত্র একটি বিল্ডিংয়ের ধ্বংসস্তুপ সরাতে যেখানে ১ মাসেরও বেশি সময় লাগে। সেখানে আমাদের দেশে বড় একটি ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি হলে ধ্বংসস্তুপ সরাতে কতদিন লাগবে সেটা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।’

অনুষ্ঠানে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলায় ১০ দফা সুপারিশ করেন ১) বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়-এর নেতৃত্বে একটি রোড ম্যাপ তৈরী করা ২) ভবন নির্মাণে ভূমিকম্প সহশীলতা নির্দেশিকা মানতে বাধ্য করা ৩) ঝুঁকিপূর্ণ সরকারী ও বেসরকারী স্থাপনা চিহ্নিত করে এগুলোকে ভূমিকম্প সহনীয় করা ৪) ভবন নির্মাণে সকল উপকরণ পরীক্ষার জন্য রিসার্চ, ট্রেনিং ও টেস্টিং ল্যাবরটরি স্থাপন নিশ্চিত করা ৫) ভূমিকম্প ঝুঁকি হ্রাস ও উদ্ধার তৎপরতা জোরদারের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সক্ষমতা বাড়ানো ৬) ভূমিকম্প ঝুঁকি হ্রাস সম্পর্কিত তথ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষর্থীদের অবহিত করা ৭) প্রতি ৩ মাস পরপর ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধারকাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাসমূহের সমন্বয় ও প্রস্তুতি পর্যালোচনা করা এবং মহড়া নিশ্চিত করা ৮) ভবন নির্মাণে নকশার ব্যত্যয় রোধে ভবনের অনুমোদিত নকশা অনলাইনে দেয়া ৯) বড় ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ ও ব্যয় নির্বাহের জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখা ১০) রাজধানীর প্রতি ওয়ার্ডে আরবান রেসকিউ টিম তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষিত করা।

“ভবন মালিকদের দায়িত্বশীলতাই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে” শীর্ষক ছায়া সংসদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতার্কিকদের পরাজিত করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়। পাবলিক পার্লামেন্ট শিরোনামে প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, অধ্যাপক ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, সাংবাদিক শাহরিয়ার অনির্বাণ ও স্থপতি সাবরিনা ইয়াসমিন মিলি। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী বিতার্কিকদের ক্রেস্ট, ট্রফি ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।