সড়ক পরিবহন নিয়ে কাজ করে, এমন সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বছরের প্রথম তিন মাসেই সারা দেশে অন্তত এক হাজার সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে, যার বড় একটি অংশ হয়েছে বাস, ট্রাক এবং কাভার্ড ভ্যানগুলোর কারণে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, এ বছর গত দুই মাসে সড়কে ১৭৮টি বাস দুর্ঘটনায় ১৮২ জন নিহত আর ৭৪৪ জন আহত হয়েছে। জানুয়ারি মাসে বাস দুর্ঘটনায় ৯৭ জন নিহত আর ৩৬৯ জন আহত হয়েছিল।
বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোয় দুর্ঘটনার পেছনে বেপরোয়া বাস চালানোসহ যেসব কারণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
১. বেপরোয়া বাস চালানো
যাত্রীবাহী একটি বাস সড়কের ডিভাইডার ভেঙে পাশের লেনের একটি মাইক্রোবাসের উপর উঠে গেছে- ২০২১ সালের এমন একটি ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছিল।
মাদারীপুরে যে বাসটি দুর্ঘটনায় পড়ে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, অভিযোগ রয়েছে যে, সেটি নির্ধারিত গতির চেয়ে অনেক বেশি জোরে চালানো হচ্ছিল।
বুয়েটের এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষণাতেও দেখা গেছে, মহাসড়কে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে, তার বড় একটি কারণ বেপরোয়াভাবে বা অতিরিক্ত গতিতে চালানোর প্রতিযোগিতা। বিপজ্জনকভাবে ওভারটেকিং, চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহার, মাদক সেবন, চালকের বেপরোয়া মনোভাব- ইত্যাদিকেও দায়ী করা হয়েছে এসব দুর্ঘটনার জন্য।
২. চালকের অতিরিক্ত ট্রিপ
হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, মাদারীপুরের ইমাদ পরিবহনের বাসটির চালক ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে না ঘুমিয়ে একের পর এক বাসের ট্রিপ দিয়েছিলেন। ঘুম ঘুম চোখে গাড়ি চালানোর এক পর্যায়ে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারান।
এছাড়া চালকরা বেতন না পেয়ে ট্রিপ ভিত্তিক টাকা পেয়ে থাকেন। এতে করে অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে ভোর বেলা অনেক সময় ঝিমুনি চলে আসতে পারে। বিশেষ করে চালকের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না করে এরকম ট্রিপ ভিত্তিক করার কারণে দেশে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে।
৩. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন
অভিযোগ উঠেছে যে, মাদারীপুরের বাসটির ফিটনেস ছিল না। গত নভেম্বর মাসেও এই বাসটি একবার সড়ক দুর্ঘটনায় পড়লেও সেটিই আবার যাত্রী নিয়ে চলাচল করছিল।
দুর্ঘটনার সময় বাসের একটি টায়ার ফেটে গিয়েছিল বলে তদন্তকারীরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছেন।
অধ্যাপক মাহবুবুল আলম তালুকদার বলছেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ যানবাহনের মালিক আর চালক ফিটনেসের তোয়াক্কা করেন না। "টাকা পয়সা দিয়েও অনেক সময় তারা ফিটনেস সার্টিফিকেট যোগাড় করে নেন বলে আমরা জানতে পারি। কিন্তু এই বাসটির তো তাও ছিল না।"
৪. নজরদারি আর তদারকির অভাব
বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের পুরো সড়ক খাতে চরম বিশৃঙ্খলা রয়েছে। যার সুযোগে ফিটনেস-বিহীন বাস চলছে, অদক্ষ চালকরা গাড়ি চালাচ্ছেন, ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী বহন করা হচ্ছে, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো হচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কারও কোন নজরদারি নেই।
বুয়েটের এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক মাহবুবুল আলম তালুকদার বলছেন, এখানে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে, যেখানে আইনকে কেউ ভয় পায় না, কারণ আইনের প্রয়োগ তো ঠিকমতো হয় না, কারও শাস্তি হয় না। তাই চালকরা ইচ্ছে মতো বাস চালায়, মালিকরা ফিটনেসের কেয়ার করে না, সব কিছু ম্যানেজ করে চলতে থাকে।"
৫. অদক্ষতা
এ্যাসোসিয়েশন অব বাস কোম্পানিজের প্রেসিডেন্ট রফিকুল ইসলাম কাজল বলছেন, চালকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো এসেছে, সেগুলো গুরুতর। গাড়ী চালানোয় তার মনোযোগ ছিল না। বার বার বলার পরেও তিনি বেশি স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, সমস্যা হলো, আমাদের দেশে চালকের লাইসেন্সে দক্ষতা যাচাই করে দেখা হয় না। টাকা পয়সা দিয়েও অনেকের লাইসেন্স হয়ে যায়। আমি মনে করি, সরকারিভাবে ড্রাইভিং ইন্সটিটিউট করে চালকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হলে তাদের দক্ষতা বাড়তে পারে।"